জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতাল: অস্ত্রোপচারের পর আইসিইউতে শিশুমৃত্যুর ব্যাখ্যা না দেয়ায় চুক্তি বাতিল যুক্তরাষ্ট্রের দাতা সংস্থার

গরিব শিশু রোগীদের হৃদরোগের অস্ত্রোপচারে চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ ও অর্থ সহায়তার লক্ষ্যে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট (এনআইসিভিডি) হাসপাতালের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি উন্নয়ন সংস্থা। অস্ত্রোপচারের পর হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রোগী মৃত্যুহার বেশি দেখা যায়। আইসিইউতে এত বেশি রোগী মৃত্যুর কারণ জানতে চেয়ে সংস্থাটি চিঠি দিয়েছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। তবে চিঠির কোনো জবাব দেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এতে ওই চুক্তি বাতিল করেছে সংস্থাটি।

এ ঘটনায় হাসপাতালটি নিয়ে আস্থাহীনতার সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, হাসপাতালটিতে বেশকিছু দেশী ও বিদেশী দাতা সংস্থা কাজ করছে। তাদের মধ্য থেকে কেউ চুক্তি বাতিল করলে অন্যদের মধ্যেও হাসপাতালটি নিয়ে সংশয়ের আশঙ্কা রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে সংস্থাগুলোর সহায়তার পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জানা যায়, গত বছরের ৭ জুন এনআইসিভিডির সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে মার্কিন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বেসিক নিডস প্রোগ্রাম। এমওইউ বাস্তবায়ন শুরু হয় একই বছরের ১ আগস্ট। ওই চুক্তির আলোকে গরিব শিশু রোগীদের অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসাসামগ্রী অক্সিজেনেটর বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছিল। আর রোগীপ্রতি নগদ অর্থ সহায়তা দেয়া হয় ৫৫ হাজার টাকা। অন্তত ২০ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হওয়ায় সংস্থাটি কারণ জানতে গত ২৮ নভেম্বর হাসপাতাল পরিচালককে চিঠি দেয়।

সংস্থাটির বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. শামিমুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, চুক্তি বাস্তবায়ন শুরুর পর থেকে চিঠি দেয়ার দিন পর্যন্ত তাদের সহায়তায় ১৫ রোগীর অস্ত্রোপচার হয়েছে। এর মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে অপ্রত্যাশিতভাবে। এর মধ্যে ১৩ বছর বয়সী মানিকগঞ্জের এক মেয়েশিশু আইসিইউতে মারা যায়। ওই শিশুর হার্টে জন্মগত ছিদ্র (ভিএসডি) ছিল। তার অস্ত্রোপচারের জন্য শিশু কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের এক সহকারী অধ্যাপকের অধীনে অস্ত্রোপচারের জন্য পাঠানো হয় ২৬ নভেম্বর। অস্ত্রোপচারের পর আইসিইউতে ওই শিশুর মৃত্যু হয়।

তিনজন চিকিৎসাধীন রোগীর মৃত্যু হওয়ার বিষয়টিতে কোনো ধরনের সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, গরিব শিশুদের কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ (হৃৎপিণ্ডে জন্মগত সমস্যা) চিকিৎসার জন্য উদ্যোগটি নিয়েছে সংস্থাটি। ভালো ফলাফলের জন্য চিকিৎসার প্রতিটি স্তর তারা পর্যবেক্ষণ করছে। উল্লিখিত ওই শিশুর মৃত্যুর বিষয়ে সন্তোষজনক উত্তর অথবা ব্যাখ্যা না পেলে চুক্তি অব্যাহত রাখা হবে না বলেও জানানো হয় চিঠিতে।

বেসিক নিডস প্রোগ্রাম কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ বিষয়ে এনআইসিভিডির পক্ষ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। এরপর গত ১৩ জানুয়ারি আরেকটি চিঠিতে এমওইউ বাতিলের কথা জানায় সংস্থাটি।

এ বিষয়ে সংস্থাটির কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. শামিমুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা প্রায় তিন বছর ধরে বাংলাদেশে কাজ করছি। এনআইসিভিডি আমাদের চিঠির কোনো উত্তর দেয়নি। ফলে আমাদের সংস্থা চুক্তি চালিয়ে নিতে আগ্রহী হয়নি। ওই চুক্তির আলোকে আমরা গরিব শিশুদের অক্সিজেনেটর দিয়েছি, যেগুলোর একেকটির দাম কমপক্ষে ৪৫ হাজার টাকা। এছাড়া তাদের নগদ ৫৫ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছিল। এনআইসিভিডি জাতীয় হাসপাতাল। ফলে আমাদের আগ্রহ বেশি ছিল।’

বেসিক নিডস প্রোগ্রাম সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট এবং ইব্রাহিম মেমোরিয়াল কার্ডিয়াক হাসপাতালে তাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। চলতি মাসে সংস্থাটির সহযোগিতায় ১০০ অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হবে। তিন বছর আগে বাংলাদেশে কাজ শুরু করে বেসিক নিডস। সে সময় দেশের প্রথম সারির একটি বেসরকারি হাসপাতালে এ কার্যক্রম চালানো হয়। তবে ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতালে গরিব রোগী না থাকায় সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে কার্যক্রম শুরু করে সংস্থাটি।

এনআইসিভিডির কয়েকজন চিকিৎসক ও কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি হাসপাতালগুলোয় রোগীর অত্যধিক চাপ ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ থাকায় বেসরকারি হাসপাতালগুলো এ সুযোগে দাতা সংস্থাগুলোকে তাদের দিকে টেনে নেয়। কোনো সংস্থা চিকিৎসায় সহযোগিতা করতে এসে এভাবে ফিরে যাওয়াটা ভালো নজির নয়। এতে দেশী-বিদেশী দাতা বা উন্নয়ন সংস্থাগুলো সরকারি হাসপাতালের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।

বেসিক নিডসের চিঠিতে উল্লিখিত শিশুর অস্ত্রোপচার করেছিলেন শিশু কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহরিয়ার জীবন রাসেল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বেসিক নিডস প্রোগ্রামের আওতায় কয়েকটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। আমিও অস্ত্রোপচার করেছিলাম। অস্ত্রোপচারের পর আইসিইউতে কয়েকজন রোগী মারা যায়। আমরা যতটুকু বুঝেছি, আইসিইউতে ভালো ব্যবস্থাপনা হয়নি। এ প্রোগ্রামের সঙ্গে আমি যুক্ত নই। অস্ত্রোপচারে কিছু রোগীর মৃত্যু হয়। এটা সারা বিশ্বেই ঘটে। চিকিৎসকের হাতে সবকিছু থাকে না। যে চুক্তি ও চিঠির কথা বলছেন, তা প্রশাসনিক বিষয়। সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারছি না।’

এ বিষয়ে এনআইসিভিডির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তারা অল্প কিছু রোগীকে সহযোগিতা করেছিল। হার্টের রোগী বিভিন্ন কারণে মারা যেতে পারে। তবে বেসিক নিডসের অন্তোষ বেশি ছিল। তাদের চিঠির কোনো উত্তর দিইনি। কেননা আমরা তাদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নই। সরকার গরিব রোগীদের চিকিৎসা করছে। বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান করছে। কেউ আমাদের চিকিৎসা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। আমাদের চিকিৎসকরা ভালো চিকিৎসা দিতে পারছেন। বেসিক নিডস নিজ ইচ্ছায় সহযোগিতা করেছিল। আবার নিজ ইচ্ছায়ই তারা প্রোগ্রাম বাতিল করেছে।’

দেশে হৃদরোগের চিকিৎসায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে একমাত্র বিশেষায়িত (টারশিয়ারি) হাসপাতাল জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ১ হাজার ২৫০ শয্যার এ বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানটিতে গত বছর ৬ হাজার ৩৪৮ রোগীর মৃত্যু হয়েছে। বছরজুড়ে হাসপাতালটির বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে দুই লাখের কিছু বেশি রোগী। জরুরি বিভাগে এসেছিল ১ লাখ ৪৮ হাজার ও ভর্তি হয়েছিল ৯৬ হাজারের বেশি রোগী। বছরজুড়ে বড় ধরনের অস্ত্রোপচার হয়েছে ৩ হাজার ৬০৬টি ও ছোট অস্ত্রোপচর হয়েছে ১৬ হাজার ৮৫১টি।

কোনো দাতা প্রতিষ্ঠান চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক বাতিল হওয়া ভালো বিষয় নয় বলে মন্তব্য করেছেন পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ডোনার এজেন্সি চলে যাওয়ার বিষয়টি ভালো নয়। দাতা সংস্থার মাধ্যমে অনেক গরিব রোগী চিকিৎসার সুবিধা পায়, ‍ওষুধ পায়, এতে কারো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ওই চুক্তি বাতিলের ফলে অল্প হলেও কিছু গরিব রোগী বঞ্চিত হয়েছে। এটা ঠিক হয়নি। যারা মারা যাচ্ছিল, তাদের বিষয়ে ন্যূনতম ভারবাল অটোপসি করার প্রয়োজন। হাসপাতালে চিকিৎসা প্রদানের সময় কিছু রোগীর মৃত্যু হলেও তার কারণ খতিয়ে দেখা উচিত। কারণগুলো চিকিৎসকরাই ভালো বুঝবেন। তারাই বিষয়টির পর্যবেক্ষণ দাঁড় করাবেন। মৃত্যুর কারণ পর্যবেক্ষণ করে ওই চিঠির উত্তর দেয়া হলে কোনো সমস্যা ছিল না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমি বিষয়টি অবগত নই। আমি খোঁজখবর নিয়ে দেখব। নিয়ম অনুযায়ী যা করার, তা-ই করা হবে।’

Source: Bonik Barta

Share the Post: