জলবায়ু পরিবর্তন: দুর্যোগের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বড় পরিবারের দিকে ঝুঁকছে ক্ষতিগ্রস্তরা

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে বাংলাদেশে। প্রভাব পড়ছে দুর্যোগপ্রবণ এলাকার বাসিন্দাদের হেলথ সিকিং বিহেভিয়ার বা স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ প্রবণতায়। প্রভাবিত হচ্ছে স্থানীয় নারী ও পুরুষের প্রজনন স্বাস্থ্য। দুর্যোগের কারণে শিশুমৃত্যুর হার বেশি হওয়া এসব এলাকার নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোয় এখন ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। এতে এসব পরিবারে এখন অধিক সন্তান জন্মদানের প্রবণতাও বাড়ছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব নারী শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি অনুভব করেন বেশি ও অতীতে সন্তান হারানোর অভিজ্ঞতা পেয়েছেন, তাদের মধ্যে অধিক সন্তান জন্মদানের প্রবণতা বেশি।

প্রজনন স্বাস্থ্যবিদ ও জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, শিশুমৃত্যুর হার, মাতৃমৃত্যুর হার এবং প্রজনন স্বাস্থ্য একটি দেশের মানুষের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নির্দেশক। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোয় শিশুমৃত্যুর হার বেশি। ফলে এসব এলাকার স্থানীয়দের অনেকের মধ্যেই ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার খোঁজে বাড়তি সন্তান জন্মদানের প্রবণতা দেখা যায়। এতে এলাকাভেদে টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা মোট প্রজনন হার (টিএফআর) কম-বেশি হতে দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে জলবায়ু, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক বৈজ্ঞানিক সাময়িকী নেচারের হিউম্যানিটিস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস কমিউনিকেশনস জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে দেখা যায়, বাংলাদেশের দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোর অর্ধেকের বেশি নারীর মধ্যে তিন বছরের কম ব্যবধানে সন্তান জন্ম দেয়ার প্রবণতা বেশি। এসব এলাকার ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ নারীর মধ্যে এ প্রবণতা দেখা যায়। আর দুর্যোগের ঝুঁকি নেই, এমন এলাকায় এ হার ৩৬ শতাংশ।

‘পারসিভড রিস্ক অব চাইল্ড মর্টালিটি অ্যান্ড ফার্টিলিটি চয়েস ইন ক্লাইমেট ভালনারেবল রিজিয়নস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই গবেষণায় উঠে আসে, চট্টগ্রাম উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় এখানে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বেশি। আর পাহাড়ি অঞ্চলে ঘেরা সিলেটে বন্যা বা ফ্লাশ ফ্লাড বেশি। এসব এলাকায় শিশুমৃত্যু হার বেশি হওয়ার বিষয়টি স্থানীয়দের মধ্যে অধিক সন্তান জন্মদানের প্রবণতায় প্রভাব রাখছে। গবেষণায় এসব এলাকার ১৫ থেকে ২৪, ২৫ থেকে ৩৪ ও ৩৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সসীমার নারীদের তথ্য নেয়া হয়েছে। এতে দেখা যায়, দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় চারটির বেশি সন্তান রয়েছে ৪৭ শতাংশ নারীর। দুর্যোগপ্রবণ নয় এমন এলাকায় চার সন্তান রয়েছে ৩৬ শতাংশ নারীর। অন্যদিকে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় ৩৫ শতাংশ মায়ের এক বা একাধিক সন্তান মারা গেছে। দুর্যোগপ্রবণ এলাকার ৫৯ শতাংশ মা সন্তানের মৃত্যু নিয়ে আশঙ্কায় ভোগেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে উল্লেখ করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট রিসার্চ বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রির মধ্যে রাখার কথা ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে। কিন্তু তার আগেই পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে পড়ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে ২ ডিগ্রি হয়ে যাবে। ২১০০ সালে বৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪ ডিগ্রিতে। এর মধ্যে ২ ডিগ্রি হয়ে গেলেই খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে। তাপমাত্রা বাড়লে সমুদ্রের গতিপথ পাল্টে যাবে। এখন থেকে ৭০ বছর পর গোপালগঞ্জ, চাঁদপুর, ফেনী সমুদ্রের অংশ হয়ে যাবে। এভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়লে খাদ্য ঘাটতির পাশাপাশি নারী ও শিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বন্যার প্রভাব বাড়বে। খরা বাড়বে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস বাড়বে। তখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শিশু ও নারীরা আরো বেশি আক্রান্ত হবে।’

গবেষণায় দেখা গেছে, সিলেট বিভাগে শিশুমৃত্যুর হার তুলনামূলক বেশি। এ বিভাগে প্রতি হাজার পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মধ্যে ৬৭টির মৃত্যু হয়েছে। আর মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ৯ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রতি হাজারে ৫০টির মৃত্যু হয়। বিভাগটিতে মোট প্রজনন হার আড়াই শতাংশ।

বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ সময় ধরে শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ইশতিয়াক মান্নান। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা জেএসআইতে কর্মরত। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘শিশুমৃত্যুর হারের সঙ্গে সন্তান ধারণ ও জন্ম দেয়ার প্রবণতার সম্পর্ক রয়েছে। ওই গবেষণাটিতে চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের তথ্য নিয়ে সে বিষয়টিই তুলে ধরা হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য পরিবারগুলো বেশি সন্তান জন্ম দেয়ার প্রত্যাশায় থাকে। বিষয়টিকে আমাদের আরো বুঝতে হবে। শিশুমৃত্যুর সঙ্গে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় সন্তান জন্মদানের প্রবণতা বেশি কিনা, সেটি নিয়ে আরো বড় পরিসরে কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে। পাঁচ বছরের শিশুদের মধ্যে যাদের মৃত্যু হচ্ছে, তাদের মধ্যে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার হার উল্লেখযোগ্য। আর দুর্যোগের কারণে রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে। এসব এলাকায় দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রে সুবিধার অভাবও শিশুমৃত্যু বেশি হওয়ার কারণ। শিশুমৃত্যু ও অধিক সন্তান জন্মদানের প্রত্যাশার সঙ্গে একটি আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট জড়িত।’

কোনো এলাকায় শিশু মৃত্যু ও জন্মের হার কম-বেশি হওয়ার বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে কাজ করা জরুরি বলে উল্লেখ করেছেন এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সূচকে উন্নতি করেছে। তবে এখন যেসব বিষয়ে পিছিয়ে রয়েছে সে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। এক সময় সারা দেশকে বিবেচনায় নিয়ে সাধারণ কর্মসূচি হাতে নেয়া হতো। এখন সেখান থেকে বেরিয়ে এলাকাভিত্তিক কাজ করতে হবে। যে এলাকায় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার বেশি, সে এলাকায় তা প্রতিরোধে আলাদা কাজ করতে হবে। এখন সারা দেশের জন্য এক কর্মসূচি এলাকাভিত্তিক উন্নতিতে অবদান রাখবে না। সুনির্দিষ্ট করে সমস্যা চিহ্নিত করে সেই এলাকায় কার্যক্রম চালাতে হবে।’

একই দেশের অঞ্চলভেদে মোট প্রজনন হার ভিন্ন হওয়ার বিষয়টি জনস্বাস্থ্যের জন্য ইতিবাচক নয় বলে মন্তব্য করেছেন পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় শিশুমৃত্যুর হার বেশি, পাশাপাশি সন্তান জন্মদানের প্রবণতা বেশি। দুর্যোগ বেশি হলে সন্তান জন্মদানের প্রবণতা বাড়বে। যেসব এলাকা দুর্যোগ হয় সেসব এলাকায় গর্ভপাত বেশি, লবণাক্ততার কারণে উচ্চ রক্তচাপ বেশি হয়। এতে ওইসব এলাকার নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিউমোনিয়ার পর পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার বেশি। দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় অন্যান্য সমস্যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যোগাযোগের অবকাঠামো না থাকা। আর যেসব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোর ব্যবস্থাপনা ও সুবিধার অভাব রয়েছে। বন্যার ফলে পানি দূষণ হয়। এতে ডায়রিয়া, কলেরায় শিশুদের মৃত্যু হয়। ফলে পরিবারগুলো নিরাপত্তার অভাবে পড়ে। কেউ নিঃস্ব হতে চায় না। কোনো কোনো শিশু দুর্যোগের কারণে বিকলাঙ্গ হয়। ফলে সক্ষম দম্পতিগুলো অধিক সন্তানের প্রত্যাশা করে। দুর্যোগ তাদের মধ্যে সন্তান হারানোর শঙ্কার জন্ম দেয়।’

তার মতে, এ অবস্থা থেকে উন্নতি করতে হলে সরকারকে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় চিকিৎসা সুবিধা যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে হবে। সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হবে। স্থা্নীয় জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, জলবায়ু পরিবর্তন, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শুধু জলবায়ু বা শুধু স্বাস্থ্যবিষয়ক কাজ করলে ওই অবস্থার উন্নতি হবে না।

জলবায়ু পরিবর্তনে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় নারীদের মধ্যে সন্তান জন্ম দেয়ার প্রবণতার পেছনে শিশুমৃত্যুর মতো পরোক্ষ কারণের পাশাপাশি কিছু মানসিক বিষয়ও কাজ করে বলে মনে করেন পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. মাহবুবুল হাসান সিদ্দিকী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এলাকার বাসিন্দাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার সময় দেখেছি, বেশি সন্তান জন্ম দেয়ার প্রবণতা ওই এলাকার দম্পতিগুলোর রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া এবং সামাজিকভাবে মর্যাদা লাভের ক্ষেত্রে বেশি সন্তান একটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।’

Source: Bonik Barta

Share the Post: