মেডিকেল শিক্ষার্থী: সার্জারি-মেডিসিনে বিশেষজ্ঞ হওয়ার আগ্রহ বেশি বেসিক সায়েন্সে কম

ব্যাচেলর অব মেডিসিন ব্যাচেলর অব সার্জারি (এমবিবিএস) ডিগ্রির পর কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হতে গেলে মেডিকেল শিক্ষার্থীকে অন্যান্য ডিগ্রি কিংবা প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থী কী বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবেন, তা মূলত নির্ভর করে তার ইচ্ছার ওপর। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে এমবিবিএস করার পর মেডিকেল শিক্ষার্থীদের সিংহভাগই মেডিসিন ও সার্জারি বিশেষজ্ঞ হতে চান। কিন্তু বেসিক সায়েন্সের গুরুত্বপূর্ণ আট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়ার আগ্রহ খুবই কম। ফলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কোনো কোনো শাখায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন চাহিদার চেয়ে বেশি, কোনো কোনো শাখায় কম। খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, স্বাস্থ্য জনশক্তির বিষয়ে দেশে কার্যকর কৌশলপত্র না থাকায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকে সামঞ্জস্য নেই।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও সার্জনে আগ্রহ বেশি হওয়ার পেছনে কিছু প্রভাবক কাজ করছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। এর মধ্যে পেশাগত অবস্থান, অনুকরণীয় ব্যক্তিদের প্রভাব, বেশি আয়, যশ ও পদোন্নতির মতো বিষয় রয়েছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী ‘বিএমসি মেডিকেল এডুকেশন’ গত জানুয়ারিতে গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশ করে। ‘মেডিকেল স্টুডেন্টস কেরিয়ার প্রিফারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে দেশের আট বিভাগের অন্তত আটশ মেডিকেল শিক্ষার্থীর ওপর গবেষণাটি চালানো হয়। গবেষণা চলে ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত। দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ১৬ জন এ গবেষণায় যুক্ত ছিলেন। তারা চিকিৎসা পেশায় শিক্ষার্থীদের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পছন্দ জানার চেষ্টা করেছেন।

গবেষণায় উঠে এসেছে, বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর প্রথম পছন্দ সার্জারি (অস্ত্রোপচার)। এরপর রয়েছে মেডিসিন। পছন্দের তালিকার তলানিতে রয়েছে বেসিক সায়েন্স ও জনস্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ শাখাগুলো।

গবেষণা বলছে, অন্তত ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থীর প্রথম পছন্দ অস্ত্রোপচার। ২৯ শতাংশের প্রথম পছন্দ মেডিসিন। বেসিক সায়েন্সের মতো বিষয়গুলোকে প্রথম পছন্দ বলেছেন ২ শতাংশ শিক্ষার্থী। জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য প্রশাসক হওয়ার ক্ষেত্রে এ হার ২ শতাংশের কিছু বেশি। আর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পছন্দ সমন্বয় করলে এগিয়ে রয়েছে মেডিসিন। ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হতে চান। এরপর সমন্বিত পছন্দে সার্জন হতে চাওয়া শিক্ষার্থীর হার ৫৪ শতাংশ। সমন্বিত পছন্দে প্রসূতি ও স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ২৭ শতাংশ, বেসিক সায়েন্স ১৪, জনস্বাস্থ্যে ১৩, স্বাস্থ্য প্রশাসনে ১৯, জেনারেল প্র্যাকটিশনার ৩৪ ও স্বাস্থ্যবহির্ভূত পেশায় যেতে চান ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষার্থীরা কোন ধরনের বিশেষায়িত চিকিৎসায় নিজেদের দেখতে চান, তা পরিপূর্ণভাবে তাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। উন্নত বিশ্বে এমনটি দেখা যায় না। এখানে শিক্ষার্থীরা দেখেন, কোন ধরনের চিকিৎসক হলে বেশি আয়ের সুযোগ রয়েছে কিংবা নাম-যশ বেশি হবে। দেশের অনেক প্রথিতযশা চিকিৎসক বা অধ্যাপক রয়েছেন যাদের মেডিকেল শিক্ষার্থীরা অনুকরণ করেন, তাদের মতো হতে চান। আবার মেডিসিন বা সার্জারির চিকিৎসক হলে পরবর্তী সময়ে আরো ডিগ্রি বা প্রশিক্ষণ নিয়ে বহু বিষয়ের চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ থাকে। ফলে তারা সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না। এছাড়া মেডিসিন বা সার্জারির চিকিৎসকরা নিজেদের অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র ভাবেন। পরিচয় দিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।

ঢাকার বাইরে একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী মীর আরাফাত হোসেন রাফসান (ছদ্মনাম)। তিনি ভবিষ্যতে সার্জন হতে চান। রাফসান বলেন, ‘‌দেশে সব শাখার চিকিৎসক সমান সুবিধা পান না। এমনকি চিকিৎসক মহলেও প্রভাব ও যশ নির্ভর করে তিনি কিসের চিকিৎসক তার ওপর। এর সঙ্গে আয়ের সম্পর্কও রয়েছে। ঢাকার দক্ষ একজন সার্জন যেখানে মাসে ২০-৩০ লাখ টাকা আয় করতে পারেন, সেখানে বেসিক সায়েন্সের চিকিৎসকরা ন্যূনতম বেতন পেয়ে থাকেন।’

চিকিৎসাবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ হলেও বেসিক সায়েন্সে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কম। বেসিক সায়েন্সের মধ্যে রয়েছে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফার্মাকোলজি, ফরেনসিক মেডিসিন, কমিউনিটি মেডিসিন, মাইক্রোবায়োলজি ও প্যাথলজির মতো বিষয়।

দেশের মেডিকেল কলেজগুলোয় এসব বিষয়ে শিক্ষকের সংকট সবচেয়ে বেশি বলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান উঠে এসেছে। তথ্য বলছে, দেশে ৩৭টি সরকারি ও ৬৭ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। এর মধ্যে সরকারিতে সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষক পদের বিপরীতে শূন্য রয়েছে আড়াই হাজার। সবচেয়ে পদ ফাঁকা বেসিক সায়েন্সে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় এ সংকট আরো বেশি।

স্বাস্থ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পদস্থ তিনজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, বেসিক সায়েন্সে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কম। এর বড় কারণ আয়ের সুযোগ ও সুবিধা কম থাকা। বেসিক সায়েন্সের বিশেষজ্ঞদের ব্যক্তিগত চেম্বার দিয়ে বা বেসরকারি হাসপাতালের মাধ্যমে রোগী দেখার সুযোগ নেই। ফলে তারা অন্যান্য চিকিৎসকের মতো আয় করতে পারছেন না। এর মধ্যে ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি ও প্যাথলজির চিকিৎসকরা বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকে স্বল্প পরিসরে কাজের সুযোগ পান। অ্যানেস্থেসিয়া বেসিক সায়েন্সে না হলেও তাতে চিকিৎসক কম। দেশে এ বিষয়ে মোট চিকিৎসক রয়েছেন প্রায় দুই হাজার।

চাহিদা অনুযায়ী দেশে বিভিন্ন বিষয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক তৈরি করতে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানগুলোর যে দায়িত্ব রয়েছে, তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন-সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহাবুব। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘কেউ সত্য কথাটি বলতে চায় না। এখন যারা চিকিৎসার জন্য পেশায় আসছেন, তাদের বেশির ভাগেরই পরিকল্পনা থাকে অধিক অর্থ উপার্জন। সেবা এখানে গৌণ বিষয়।’

তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়নে সরকারের পরিকল্পনা ও কৌশল নেই। রাষ্ট্রই নির্ধারণ করবে কোন ধরনের বিশেষজ্ঞ বেশি প্রয়োজন। বেসিক সায়েন্সে আয় কম। ফলে একজন চিকিৎসক কেন এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবেন, তা রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে সমতা আনতে হবে, জনশক্তি উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের পেশাগত পরিকল্পনা সরকারের থাকতে হবে।’

কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশেষীকরণের চিন্তাধারা আসে ১৮৮০ সালে। পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে এর বিস্তার হয়।

অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকান মেডিকেল কলেজ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে ১৬০টির বেশি বিশেষায়িত ও উপবিশেষায়িত চিকিৎসা শাখা রয়েছে। বাংলাদেশেও প্রায় ১০০ বিশেষায়িত শাখা রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য পেশাজীবীরা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ও ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের (ডব্লিউএফএমই) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মেডিসিন ও সার্জারিতে ক্যারিয়ার গড়লে অনেক সুপার স্পেশালিটির চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ রয়েছে। যেমন কার্ডিয়াক, নিউরো কিংবা অর্থোপেডিক সার্জন হওয়ার সুযোগ রয়েছে। একইভাবে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হওয়ার পর সুনির্দিষ্ট বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ ও ডিগ্রি শেষে নানা ধরনের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হওয়া যায়। যেমন জেনারেল মেডিসিন, কার্ডিওলজিস্ট, ইন্টারর্নাল মেডিসিন, ফিজিক্যাল মেডিসিন, নিউরোমেডিসিন ইত্যাদি। অন্যদিকে বেসিক সায়েন্সে এত সুযোগ নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা এসব বিষয়ে অধিকতর ডিগ্রি নিতে চান না।’

দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কত প্রয়োজন এবং আগামীতে কী অবস্থা হবে, তার পরিকল্পনা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জনসংখ্যার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়নের কৌশলপত্র প্রয়োজন। সব দেশের সরকার এ কাজ করলেও বাংলাদেশে দেখা যায় না। দেশে সাধারণ চিকিৎসক কতজন লাগবে, বিশেষায়িত চিকিৎসক কতজন লাগবে, তা বিবেচনা করতে হবে।’

বিশেষায়িত চিকিৎসক হওয়ার পেছনে সুযোগ-সুবিধা ও আয়ের বিষয়টি কাজ করে বলে মনে করেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বেসিক সায়েন্সের জন্য ইনসেনটিভ প্রয়োজন। তারা প্র্যাকটিসের সুযোগ পান না, তাদের আয় কম। সদ্য এমবিবিএস করা চিকিৎসক সেসব শাখায়ই যেতে চান, যেখানে সুবিধা বেশি। সরকার এ বিষয়ে ভাবছে। স্বাস্থ্য জনশক্তির কৌশলপত্র তৈরির জন্য আমরা সরকারের সঙ্গে কাজ করছি।’

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বেসিক সায়েন্সে যেন চিকিৎসকরা আসেন, এজন্য সরকার চেষ্টা করছে। তাদের সুযোগ-সুবিধা ও প্রণোদনা দেয়ার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে।’

Source: Bonik Barta

Share the Post: