ট্রামের শহর কলকাতা; আছে দুই চাকার রিক্সাও

ট্রাম। দেখতে নাকি ট্রেনের মত তবে আকারে ছোট। সেই কৈশোর থেকে অনেক জল্পনা-কল্পনা, ট্রাম দেখতে কেমন? প্রযুক্তির কল্যাণে একটু-আধটু দেখতে পেয়েছি। সেই একটু-আধটু দেখার পর একবার সুযোগ হয়েছিল চোখ মেলে দেখবার। বছর দু’য়েক আগে আন্তর্জাতিক একটা সম্মেলনে গবেষনা পত্র উপস্থাপনের জন্য বাংলার প্রথম রাজধানী কলকাতায় তিন বন্ধুর যাওয়ার সুযোগ মিলল। গবেষকের ভাব ভঙ্গি নিয়ে গবেষণা কর্ম উপস্থাপনের জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছি, মনের ভিতর সুপ্ত ইচ্ছেগুলো অনায়াসেই প্রকাশ পেতে থাকল।

সম্মেলন শেষে এবার কলকাতা ঘুরে দেখবার পালা। বাঙ্গালী সংস্কৃতির বিস্তারের কারণে মনেই হয় না যে, বিদেশে এসেছি। তারপরও বিদেশ বলে কথা। এ ভাবনা নিয়ে দেখলাম বহু কিছু, ঘুরলাম বহু জায়গায়। তবে সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে ট্রামের ঠং ঠং শব্দে রোমাঞ্চকর অনুভূতি। আর দুই চাকার টানা রিক্সা তো কলকাতার বৈশিষ্ট্যকে স্বাতন্ত্র রুপ দান করছে।

ট্রামের শহর কলকাতা, ট্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা ইতিহাস। আছে রোমান্টিকতা, বিপ্লব, ঐতিহ্য সবচেয়ে বড় বিষয় হলো অন্যান্য মাত্রার স্বাতন্ত্রতা। টালীগঞ্জ, ধর্মতলা, ডালহৌসী, শিয়ালদাহ, নিউমার্কেট, চিতপুর, চৌরঙ্গি, খিদিরপুর, শ্যামবাজারসহ বিভিন্ন রুটে চলে বৈদ্যুতিক ট্রাম।

খুব আটঁসাট সময়, এর মাঝে যেতে হবে অনেক জায়গায়। সময় মেলে তো ট্রামের রুট মেলা ভার। শেষে কি ট্রামে না চড়েই কলকাতা ত্যাগ করব। বন্ধুরা মার্কেটে ব্যস্ত সময় পার করছে, আমি তাই সময় পেয়েই চড়ে বসলাম ট্রামে। ধর্মতলা থেকে ট্রামে উঠলাম ঠিকই কিন্তু যাব কোথায়? রুট বা কোন জায়গার নামই তো জানি না। শেষে চুপচাপ বসে রইলাম। যেখানেই হোক যাব, অজানা রুটেই। টুন টুন শব্দে ঘণ্টি বাজিয়ে ট্রাম থামছে আবার চলছে, ইঞ্জিন ও লৌহ চাকার মাদকতার সুর মনের মাঝে বিরহের ঘণ্টা বাজায়। মন্থর গতিতে চলছে ট্রাম। একই রাস্তায় চলছে নানা যানবাহন। কোন যানজট ছাড়াই কেমন করে চলছে এ সরলরেখার ট্রাম। সামনে কোন অনাকাঙ্খিত যানবাহনের উপস্থিতে থামছে লোহা ও ইস্টিলের এ বৈদ্যুতিক বাহনটি।

দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, কানপুর, নাসিক থেকে অনেক আগেই উঠেছে ট্রাম। তবে এখন ভারতে ট্রামের একমাত্র ঠিকানা হয়ে আছে কলকাতা শহর। আর্থিকভাবে লাভজনক না হলেও কেন্দ্রীয় সরকার ট্রামকে টিকিয়ে রাখতে কাজ করছে। ভারতে বিভিন্ন শহরে এখন এর বিস্তারে কাজ করছে সরকার। কলকাতায় ট্রামকে সম্পূর্ণরুপে ‘কলকাতার অতি নিজস্ব ঐতিহ্য’ রূপে আখ্যায়িত করা হয়।

কলকাতার মত ব্যস্ত শহরে ট্রাম তার চরিত্রগত স্বস্থির গতির মাধ্যমে দূষণমুক্ত একটি যান্ত্রিক বাহন ও সস্তা সেবা প্রদান করছে। কলকাতা ভারতের একমাত্র শহর এবং বিশ্বেরও সেই কয়েকটি শহরের মধ্যে একটি যেখানে এখনও ট্রামের প্রচলন রয়েছে। ১৮৭৩ সাল থেকে কলকাতায় ট্রাম চলে আসছে। ট্রাম থেকে কলকাতা শহরের আবেগের সান্নিধ্য দেখা যায়। ট্রাম কলকাতার বিভিন্ন কেন্দ্রের মধ্যে দিয়ে চলাচল করে প্রায় পুরো কলকাতাকে জড়িয়ে ধরেছে।

ট্রামের ঠং ঠং আওয়াজ কবির কাব্যিকতা প্রকাশ করে। কলকাতা ট্রামওয়ে গণপরিবহণ ব্যবস্থায় প্রথম সংগঠিত প্রতিষ্ঠান। ১৮৮২ এবং ১৮৮৪ সালের মধ্যে খুব অল্পসময়ের জন্য খিদিরপুর এবং চৌরঙ্গী এলাকায় বাষ্পচালিত ট্রাম চলে। লাইনগুলিতে অবশ্য ঘোড়া চালিত ট্রামই চলত।

১৯০২ সালে কলকাতা ট্রামওয়েতে বিদ্যুতায়ন সম্পূর্ণ হয়। একই বছরে খিদিরপুর এলাকায় প্রথমবারের মতো বিদুৎচালিত ট্রাম চলে। বিদ্যুৎ সংযোজন সম্পূর্ণ হলে কলকাতার ট্রামওয়েতে এক অস্বাভাবিক উন্নতি ঘটে। ভারতের স্বাধীনতার পর কোম্পানি এবং পশ্চিম বাংলা সরকারের মধ্যে ব্যবস্থাপনা ও মালিকানা নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। ১৯৬৭ সালের অ্যাক্ট-এর মাধ্যমে সরকার কলকাতা ট্রামওয়ে কোম্পানিকে জাতীয়করণ করে।

আর একটি দ্বি চক্র যান কলকাতার ঐতিহ্যকে বিস্তৃত করছে। দুই চাকার টানা রিক্সা। ঘোড়ার গাড়ির দুই চাকা নিয়ে এ দ্বি চক্র যানটিকে সামনে থেকে এক জন টেনে নিয়ে যায় যাত্রীর গন্তব্যে। দেখলে মনে হয় যাত্রি বুঝি উল্টে যাবেন, কিন্তু এ রকম ঘটেই না। সামনের রিক্সাওয়ালা হেঁটে হেঁটে এটিকে খুব সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে টেনে নিয়ে যান। কলকাতার একবালপুর লেনে এ রিক্সায় চড়ে এর উচ্চতার জন্য বেশ আরামই বোধ করলাম।

পরিবহনের এ মাধ্যমটি ‘রিক্সা’, যা পশ্চিমবঙ্গে সচরাচর সব সময় মানুষের অবলম্বন হিসাবে কাজ করছে। পায়ে হেঁটে টেনে নিয়ে যাওয়া এটি দাসত্বের প্রতিক রুপে প্রকাশ পায় বলে অনেকেই মনে করেন।

জাপানীদের কাছে রিক্সা হলো ‘জিঁরিকিশা’ যার আক্ষরিক অর্থ হল মানব-চালিত যানবাহন। ১৯০০ সালে চীনা অভিবাসীদের দ্বারা কলকাতায় এটির প্রবর্তন হয়েছিল এবং তখন থেকেই এটি পরিবহনের জনপ্রিয় মাধ্যম হিসাবে এখানে রয়ে গেছে। রাস্তায় ভারি পরিবহনের একমাত্র বিকল্প হল এই রিকশা। এগুলি স্বল্প দূরত্বে ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত এবং যখন কেউ তার গন্তব্যের খুবই কাছে পৌঁছতে চায় তখন অনেকেই এটিকে পছন্দ করেন।

রুপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাস কলকাতা শহরের রাস্তায় রাস্তায় রাতভর হাঁটতেন। “পথহাঁটা” কবিতায় সে উচ্চরণ করেছেন- ‘কী এক ইশারা যেন মনে রেখে একা-একা শহরের পথ থেকে পথে/ অনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি ট্রাম-বাস সব ঠিক চলে;/ তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হয়ে চলে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে:’।

কলকাতার রাস্তায় দিনে-রাতে, বিভিন্ন অলিতে গলিতে কখনও মন্থর কখনও বা দ্রুত পা ফেলেছি। মনে হয়েছে দেশ থেকে বিদেশের মাটিতে আমাদের পিছু পিছু আত্রলিতা এসেছে এই কলকাতায়। ঐতিহ্যের এই শহরের অলিতে গলিতে উঁকি ঝুঁকি মারছে বিশ্বমাধূরী প্রিয়তমা।

Share the Post: