সম্মানে থাকুন বাবা

তপ্ত দুপুর। ঠিক মধ্য দুপুরও নয় শেষ দুপুর বলা চলে। এরপরও রোদের সে কি তেজ। কোনোভাবেই যেন সূর্যটা সময়ের কাছে হার মানতে চাচ্ছে না। রোদের এমন চির সত্য আয়োজনের মধ্যে উত্তপ্ত পিচঢালা রাস্তা দিয়ে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে হেটে যাচ্ছেন আফজাল হোসেন। ৪০ উদ্ধো এই ব্যক্তি রিক্সা বা অন্য কোন যানবাহনে উঠছেন না। শেষ দুপুরে ক্ষুধার চোটে পেটে হাজার ইঁদুর বিপ্লব করলেও আরও দুই ঘণ্টা পার করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এই তো দুই ঘণ্টা পর বাসায় গিয়ে তখনই না কিছু মুখে দেওয়া যাবে। বাইরে খেতে হলে তো অনেক পয়সা লাগবে। ভাবছেন কিছু টাকা যদি কম খরচ করা যায়।

ঠিক এমনভাবে না খেয়ে আজমত আলী রোদের মধ্যে ক্লান্ত দেহে টুংটাং বেল বাজিয়ে রিক্সা টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। রিক্সা টেনে নেওয়া যেমন কষ্টের তার চেয়েও নিজের ক্লান্ত দেহ বহন করা আরও কষ্টের। তারপরও যেন থামা যাবে না। সংসারের জন্য কাজ করে যেতেই হবে। যে সংসারের বাতি হলো সন্তান। নিজের সন্তানের জন্য কিছু করতে হবে এবং সন্তানের ভবিষৎ নিজের হাতে গড়ে দেওয়ার জন্য এই বাবা কতশত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

বাবারা সব পারেন, সন্তানের জন্য সব করেন। যে তরুণ-যুবক স্বেচ্ছাচারী হয়ে কতই না আড়ম্বরপূর্ণ ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে দিননানিপাত করত সেই তরুণই এক দিন অনাড়ম্বরের সারথী হয়ে যান। কারণ তিনি বাবা হয়ে সন্তানের জন্যই যেন পৃথিবীর সব স্বাচ্ছন্দ কিনে আনেন। সন্তানের সুখের সওদাগর বনে যান। ডাক হরকরার মত বাবারা ছোটাছুটি করেন নিরন্তন। সন্তানের জীবনে যেন পঙ্কিলতার কোন স্পর্শ না লাগে এ জন্য বাবা ছিলেন অতন্দ্র প্রহরী। পরম নির্ভরতায় বাবার হাত ধরেই সন্তানের পথচলা শুরু হয়ে অবিরত চলতেই থাকে। নিরবে-নিভৃতে বাবারা সন্তানের জন্য সুখ ত্যাগ করেই যান। এ ত্যাগ কোন ইতিহাসে গাঁথা হয়ে প্রতিষ্ঠিতভাবে গুনঞ্জন তোলে না, এ ত্যাগ আপাত কোন প্রাপ্তি আশা করে না। এ ত্যাগ শুধুই ভালোবাসার।

বাবা। মধুর এক শব্দে পৃথিবী জোড়া নির্ভরতা যুক্ত। প্রতিটি মানবসন্তান এ নির্ভরতার ছায়ায় জীবনভর থাকতে চান। কিন্তু তা কি হয়? বাবারা আসেন সন্তানের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে তারপর নিরবে-নিভৃতে চলে যান। বাবা চলে যাওয়ার পরেই না সন্তানের কাছে বাবার অভাব অনুভূত হতে শুরু করে।

সন্তানের কোন আবদার অপূর্ণ রাখেছেন কোন বাবা? না রাখেননি। সামর্থ্যে না কুলালেও বাবা মুখে হাসি ফুঁটেয়ে শত অবদার পূরণের আশ্বাস দেন। যে আশ্বাসে সন্তান আনন্দে আন্দোলিত হয়ে চিত্ত নাড়িয়ে লাফয়ে উল্লাস করে অন্য দিকে অসমর্থ্য বাবা দুঃশ্চিন্তায় থাকেন প্রিয় সন্তানের আবদারের বস্তুটি সন্তানের হাতে তুলে দিবেন কিভাবে।

বাবার হাতের কড়ে আঙ্গুলটা ধরেই না পথ চলা শুরু। এই তো সে দিনই না বাবার বা হাতের কড়ে আঙ্গুল ধরে গ্রামের মেঠো বাট দিয়ে গ্রাম্য মেলায় প্রথম যাওয়া হয়েছিল। বাবার হাত ধরেই শত ভীড়ে রঙ্গিন পৃথিবী চিন্তামুক্তভাবে আবিষ্কার করা হয়েছিল, হারিয়ে যাওয়ার নেই কোন ভয়; বাবার আঙ্গুল যে আছে হাতের মুঠোয়। সবে মাত্র হাটতে শেখা সন্তান বাড়ির বাইরে প্রথম পা ফেলে বাবা হাত ধরে। বাইরে গিয়ে ছোট্ট অচেনা চোখে ঠেকেছে হাজার হাজার অচেনা-অজানা কত কি…। বাবা ওটা কি, ওটা কি বাবা? ওই যে ওইটা, দেখ দেখ বাবা, এই তো গেল! পৃথিবীর সব কিছুই বাবা আঙ্গুল উঁচু করে চিনিয়ে দেন। শুরু হয় সন্তানের অবিরল পথচলা। সন্তান যখন একটু ঠিকঠাকভাবে পথ চলতে শুরু করে তখন বাবারা চলে যান। আর ফেরেন না। সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে বাবাদের যেন চুক্তি হয় চুপটি করে চলে যাওয়ার।

বাবা নেই। নেই শব্দটার সেঙ্গই বুক হু হু করে উঠে না ফেরার শত ক্রন্দন ধারা। বাবা এক চিরন্তন খুঁটি। সেই খুঁটি জীবনের, জীবনের খুঁটিটা হুট করে অদৃশ্য হয়ে গেল। আজ সেই খুঁটি নেই। কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে আছি। সব সময় মনে হয় এই তো এখনই প্রকাণ্ড এক ঝড় এসে আমায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে। কেউ ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু গেল ২৫ বছরের জীবনে অনেক ঝড় এলেও সে ঝড় আমাকে উড়িয়ে নিবে এ চিন্তা ঝড়ের কল্পনাতেও ছিল না। আজ সেই ঝড় রূপি বাস্তবতা আমাকে গো গ্রাসে গিলে ফেলতে চাচ্ছে। কত সাহস এই বাস্তবতার! সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই বাস্তবতা তার হিসাব নিতে ঠিকই আমার সমনে উপস্থিত হয়েছে। বাস্তবতা বলতে যে কোন বিষয় আছে তা বাবা থাকতে বিন্দুমাত্রও টের পাইনি।

সাত ভাইয়ের ছোট, বাবার ছোট সন্তান হওয়ার কারণে ভালোবাসা ও অভিমান একটু বেশিই ছিল যেন। সেই অভিমান এখন আর হালে পানি পায় না, পাবেও না। মাত্র ৭ দিন পূর্বে রাত দশটায় টেলিভিশন স্টেশনের বার্তা কক্ষে ব্যস্ত সময় পার করছিলাম। ঠিক সে সময়ই বড় ভাইয়ের ফোন, ‘আব্বা বেশ অসুস্থ। আমরা হাসপাতালে, তুই অফিস থেকে বেরিয়ে চলে আয়।’ সেল ফোনটা কান থেকে টেবিলে রেখে দিয়ে কম্পিউটারের স্ক্রিনে এক নাগাড়ে তাকিয়ে কি যেন হাতরাচ্ছিলাম। কিসের যেন একটা প্রতিবেদন লিখছিলাম, তখনও শেষ হয়নি। উঠে দাঁড়ালাম। এর আগেও বেশ কয়েকবার অসুস্থ হলেও এই অসুস্থের খবরে হৃদয়টা কেন যেন কেঁপে উঠল। এরপর ফোনের পরে’ ফোন এলো। আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ঢাকায় অপর ভাইয়ের সঙ্গে মধ্যরাতে বাড়ির পথে। শ্বাস বন্ধ হয়ে দেহ থেকে প্রাণ চলেও যাওয়ার শেষ মুহূর্তে যেমন দেহ মৃদু কেঁপে উঠে তেমনি মন কেঁপে উঠল আমার। বাবা অসুস্থ কিন্তু সবার ব্যতি ব্যস্ততায় তো তা মনে হচ্ছে না। চোখ দিয়ে অজান্তেই বারিধারার নহর বইতে লাগল। পথি মধ্যে ভাই আস্তে করে জানালেন, বাবার চলে যাওয়ার কথা।

কেউ থাকবে না। এ তো জানা কথা। কিন্তু সেই কেউয়ের ভিতরে কি বাবা আছেন? বাবা না থাকলে কি চলা যায়? বাবা ওই রাত থেকে আর নেই। প্রায় তিনশত কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ভোরের একটু পরে বাড়ি পৌঁছে দেখি বাবার নিজ হাতে সাজানো ঘরের সামনেটায় ডজন ডজন চেয়ারে চুপ করে বসে আছেন অনেক মানুষ। আমি কারও দিকে তাকাতে পারলাম না। সোজা চলে গেলাম শেষ কক্ষে মায়ের কাছে। এরপর হয় নিজেদের অবলম্বন হারানো মা-ছেলের দুঃখের মহামিলন।

বাড়িতে যে কয়দিন ছিলাম, প্রতি রাতে পৌর কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করেছি তার সঙ্গে কথা বলার। কিন্তু আমি কথা বললেও বাবার কবরটা ছিল একদমই নিরব। আমার বাবা আজ নেই। সব বাবার সঙ্গে সন্তানদের যেমন সুন্দর স্মৃতি থাকে আমার তেমনি অনেক স্মৃতি রয়েছে। বাবার কক্ষে বাবার পানদানি, টর্চ লাইট ও চশমাখানা পড়ে আছে নিরুত্তাপ। ওই বস্তুগুলোও যেন শোকের মাতমে দিশেহারা। আমি বাবার বিছানায় বসে আলমিরা ভরা বই হাতড়ে বাবার স্পর্শ খুঁজেছি। স্পর্শ পেয়েছি কিনা জানি না তবে বিশ্ছেদের কড়া কষ্টটাই অনুভূত হয়েছে।

বাড়ির প্রতিটি কানাচে বাবার হাতের ছোঁয়া, নিরাপদ ও ভরসার। বাড়ির এমন কোন ধুলিকনা পেলাম না যেখানে বাবার পদস্পর্শ নেই। বাগানের গাছগুলো যেন আমার মতই চরম শোকে বিহ্বল। অভিভাবকত্ব হারিয়ে বিশাল আসমান উচ্চ আহাজারি করেই চলছে। প্রতি মধ্যরাতে মাতমে চক্রাকারে গুঞ্জন করছে বৃক্ষরাজি। তারা তাদের যত্ন নেওয়ার মানুষটিকে হারিয়ে নিশ্চল হয়েছে। তারা জনমের মত হারিয়েছে তাদের ভরসা।

বাবার শোক কাটিয়ে বাস্তবতার টানে জীবনের সন্ধানে চলবো ঠিকই কিন্তু শোকাতুর হৃদয়ের দাগ কখনও মুছে যাবে না। আগে কখনও বুঝিনি বাবা হারানো কত ব্যাথার। যাদের বাবা এখনও আছেন তারা এ ব্যাথা বুঝবেন না। ব্যাথা না থাকলে ব্যাথার স্বাদ কি বোঝা যায়? আর যাদের বাবা নেই তাদের যে শুধু বাবা নেই তা নয়, তাদের পৃথিবীর অবলম্বনটাই নেই।

যুদ্ধে লড়াইরত সৈনিককে তলোয়ারের আঘাত থেকে ঢাল যেমন বাঁচিয়ে রাখে তমনি বাবা সব অপঘাত থেকে সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখেন। ঢাল না থাকলে কি হতো তা সৈনিক কিছুটা বুঝতে পারেন হয়ত কিন্তু ঢাল না থাকার অভাব তাকে তদরুপ তাড়না দেয় না যদরুপ ঢালহীন সৈনিকের হয়। ঢালহীন সৈনিক বুঝতে পারে ঢাল তার জন্য কতটুকু জরুরি। তেমনি বাবা হারানো সন্তান বুঝতে পারে বাবা তার জীবনে কি ছিলেন? বাবার জন্যই সে কতটুকু সাহসী ও প্রাণচঞ্চল ছিল।

চিরকাল কেউ থাকবে না সত্য। আমরা কেউ থাকব না। পিরোজপুরের কবি আহসান হাবিব সড়কের ৩৯৭নং বাড়িটা এখন বেশ খালি। বাড়ির স্তম্ভগুলো যেন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। আল্লাহ আমার বাবাকে সুখে ও শান্তিতে রাখুন। বাবাকে সম্মানের সহিত রাখুন। বাবা হারানো সন্তান আল্লাহর কাছে বাবার জন্য দোয়া করছে আজ।

Share the Post: