শীতের প্রকোপ বাড়তে না বাড়তেই আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃতের সংখ্যাও বাড়ছে। শীতের কামড় থেকে বাঁচতে আগুন পোহানের সময় দগ্ধ হচ্ছেন এসব মানুষ। এমন দগ্ধ হয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলেই মৃতের সংখ্যাই বেশি। সচেতনতা ও সতর্কতার অভাবে এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বলে দাবি করছে প্রশাসন।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দারিদ্রতা ও অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতাও এর জন্য দায়ী। শীতকালে উষ্ণতার জন্য আগুনে তাপ নেওয়ার সময় দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক কর্মকাণ্ডই এমন ঘটনা হ্রাস করতে পারে।
রংপুর নগরীর পাশারিপাড়ার গৃহবধু রোকেয়া বেগম আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হয়েছিলেন। তার শরীরে ৫৫ শতাংশই পুড়ে যায়। গেল বছরের ২৮ ডিসেম্বর রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে আনা হলে ৯ দিন চিকিৎসা করেও বাঁচানো যায়নি তাকে। গত মঙ্গলবার তিনি মারা যান। এমনই হলো নীলফামারীর জলঢাকার পাঠানপাড়ার গৃহবধু বেগম নেছার গল্প। আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হয়ে গত ২৪ ডিসেম্বর রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি হন তিনি। খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহান গৃহবধূ নেছা। এসময় তার শাড়ির আঁচলে আগুন লেগে শরীরের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে যায়। গত বৃহস্পতিবার সকালে তিনিও মারা যান।
চলতি বছরের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত শুধু মাত্র রংপুর মেডিকলে কলেজ ও হাসপাতালে দগ্ধ হয়ে মৃতের সংখ্যা ৬ জন। গত ২০ ডিসেম্বর পর থেকে দগ্ধ রোগী আসছেন বলে জানান হাসপাতালটির বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. এম এ হামিদ পলাশ। তিনি বলেন, ‘আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হওয়া রোগী অক্টোবর ও নভেম্বরে পাওয়া যায় না। তার মানে শীতের প্রকোপ যখন বেশি থাকে তখনই এমন হয়। চলতি শীতে ২ জানুয়ারি পর্যন্ত দগ্ধ ৫৬ জন ভর্তি হয়েছেন যার মধ্যে ১২ জনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। আর ৮ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।’
আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হওয়া রোগী বেশি আসেন রংপুর মেডিকলে কলেজ ও হাসপাতালে- ফাইল ছবি
অগ্নিদগ্ধ রোগীদের মধ্যে নারী, শিশু ও বয়স্করা বেশি বলে জানান ডা. হামিদ পলাশ। তিনি বলেন, ‘৪০ শতাংশের উপর শরীর পুড়লে আমরা এখানে আর রাখতে পারি না। ঢাকায় পাঠিয়ে দেই। এক্ষেত্রে যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন একটা ভালো না, উন্নত চিকিৎসার সামর্থ নাই তারাই বেশি মারা যান। কিছুটা নিজেদের গাফলতিও রয়েছে। এমন রোগী কিন্তু ঢাকায়ও কম নয়।’
তবে গত কয়েক বছরের চেয়ে এ শীতে দগ্ধ রোগী কম বলে জানান ডা. এম এ হামিদ পলাশ। শীতের সময়টা এখনও শেষ হয়নি এবং কিছুদিনের মধ্যে দগ্ধ হওয়া রোগীর সংখ্যা হাসপাতালে বাড়তে পারে বলে আশংকা করছেন তিনি। আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধর ঘটনা প্রতিরোধে হাসপাতাল বা চিকিৎসকরা কি পদক্ষেপ নিচ্ছেন এমনটি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগুন পোহাতে গিয়ে যেন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় এ জন্য আমরা দুই মাস আগেই কাজ শুরু করেছি। ক্যাম্পেইন করছি, পোস্টার লাগাচ্ছি।’
তবে অনেক ক্ষেত্রে এমন পোড়া রোগীদের জন্য চিকিৎসকেরও কিছু করার থাকে না উল্লেখ করে এম এ হামিদ পলাশ বলেন, ‘আগুনে পুড়ে তারা শেষ মুহূর্তে আমাদের কাছে আসেন। প্রথমে ক্ষতিকর মলম বা অন্য কোন কিছু লাগিয়ে থাকেন। গ্রাম্য চিকিৎসকের কাছে গিয়ে শুধু তাদের উপরই নির্ভর করেন দগ্ধরা। যখন অবস্থা সংকটাপন্ন হয় তখন আমাদের কাছে নিয়ে আসা হয় কিন্তু সে সময় আমাদের তেমন কিছু করার থাকে না।’
আগুনে পোড়া রোগীর ভিড় উপচে পড়ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে- সংগৃহীত
জানা যায়, আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হয়ে শুধু মাত্র ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ২৭ জন মারা যান। ঐ বছর সারাদেশে প্রায় ৬ সহস্রাধিক এমন দগ্ধ রোগী হাসপাতালে আসেন। চলতি শীতের মৌসুমসহ গত দুই শীত মৌসুমে (২০১৮ ও ২০১৯) এমনভাবে আগুনে দগ্ধ হয়ে অন্তত ৪০ জন মারা যান। যাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ ৫৫ উর্দ্ধ নারী। নারীদের ক্ষেত্রে শাড়ির আঁচল, চাদর, ল্যাহেঙ্গা, উলের চাদরের মতো পোশাকে আগুন অসাবধনতার কারনে আগুন লাগে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। কখনও কখনও গরম পানি দিয়ে গোসলের সময় পানি মাত্রাতিরিক্ত গরম থাকায় তাতেও মৃতের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়। রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারি, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, গাইবান্ধ জেলায় এমন দগ্ধের ঘটনা বেশি ঘটে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট ঘুরে আগুনে পোড়া রোগীদের সংকটাপন্ন অবস্থা দেখা যায়। অবস্থার অবনতি হলে মূলত উত্তরাঞ্চলের হাসপাতলগুলো থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে দগ্ধ রোগী পাঠানো হয়। এছাড়াও ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো থেকেই শরীরের ৪০ শতাংশের উপর দগ্ধ হওয়ারাই মূলত এখানে আসছেন।
তুহিন ওয়াদুদ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষক দগ্ধের এমন ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করছেন- সংগৃহীত
দীর্ঘদিন ধরে উত্তরাঞ্চলে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হওয়ার ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ। এমন দগ্ধ হওয়ার পিছনে তিনি অসচেতনতা ও অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা এ দুই বিষয় রয়েছে বলে মনে করছেন। তিনি একুশে টেলিভিশনকে বলেন, ‘এমন ঘটনা উত্তরাঞ্চলেই বেশি ঘটে কেননা রংপুর বিভাগে দেশের সবচেয়ে গরীব পাঁচ জেলার অবস্থান। কুড়িগ্রামে ২০ থেকে ২২ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ১৫ লাখ-ই গরীব যা শতকরা ৭১ শতাংশ। তারা খড়ে আগুন জ্বালিয়ে শীত প্রশমনে বাধ্য হন।’ এ অঞ্চলের মানুষ যেসব বস্তু দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে থাকেন তা অতি অল্প সময়েই প্রখর রূপ ধারণ করে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মূলত দুই কারনে এমনটি হয়। প্রথমটি হলো বাইরে যেমন ঠান্ডা, তাদের ঘরের ভেতরটাও তেমন ঠান্ডা। ঘরের মধ্যে তারা গরম পাচ্ছেন না। তাদের ঘরগুলো যা দিয়ে তৈরী তাতে ঘরের পরিবেশ গরম থাকে না। বেশিরভাগ ঘরের চাল টিনের তৈরী হওয়ায় শীতের সময় ঠান্ডা জেঁকে বসে। তাই তারা আগুন পোহাতে বসেন। আরেকটি কারণ হলো অসচেতনতা। তারা অগুন জ্বালিয়ে একেবারে আগুনের ভিতর হাত পা ঢুকিয়ে দেন। এ সময় তাদের গায়ে যে পোশাক থাকে তাতে আগুন ধরে যায়। তখনই মূলত তারা অগ্নিকাণ্ডের শিকার হন।’
আগুন লাগার পরে তাৎক্ষণিক কি করতে হবে তা এসব অঞ্চলের মানুষজন তেমন একটা জানেন না উল্লেখ করে তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘আগুন লাগলে তারা দিশেহারা হয়ে যান। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের কথা তারা জানেন না। ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কেননা যে সব পোশাক গায়ে থাকে তাতে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।’ আগুন পোহানোর রেওয়াজটা এ অঞ্চলে সাংস্কৃতিক কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আগুন পোহানো যতটুকু না সাংস্কৃতিক তার থেকেও অপরিহার্য। কেনন আপনি লক্ষ্য করবেন আমরা যে ত্রাণ শীতের সময় দিয়ে থাকি তা কম্বলই হয়। কিন্তু মাফলার, হাত মোজা, পা মোজা বা সোয়েটার কিন্তু আমরা দিই না। শীতের বস্ত্র বলতে শুধু কম্বল নয়।’ এমন ঘটনা যেন না ঘটে তার জন্য সচেতনতামূলক বা প্রতিরোধমূলক কোন ব্যবস্থাই তেমন একটা চোখে পড়ে না বলেও জানান তুহিন ওয়াদুদ।
দগ্ধ এক নারীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে- সংগৃহীত
উত্তরাঞ্চলের আগুন পোহানোর বিষয়টা প্রথাগত ও সাংস্কৃতিক বলে মনে করেন রংপুর মেডিকল কলেজ ও হাসপাতালের সদ্য সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. শাহাদাত হোসেন। তবে আগুনে দগ্ধ হওয়াকে কিছুটা অসচেতনতা ও কিছুটা দুর্ঘটনা বললেন তিনি। এমন সচেতনার অভাব দুই এক দিনে যাবে না এর জন্য দরকার দীর্ঘ পরিকল্পনা উল্লেখ করে ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আসলে এ অঞ্চলের মানুষগুলো একটু গরীব। তাদের শীতের পোশাক তেমন একটা নেই। এ ছাড়াও আগুন পোহানো একটা প্রথাগত বিষয়। সকাল ও সন্ধ্যা বেলায় আগুনের কুন্ডলি করে তারা চারপাশ ঘিরে বসে এ সময় কাপড়ে আগুন ধরে যায়। আগুন পোহানোর বিষয়টা সাংস্কৃতিকও। এটাকে এ অঞ্চলের সহজ সরল মানুষগুলো বিষয়টি উদযাপন করে থাকেন।’
তবে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হওয়ার ঘটনা শীতবস্ত্রের অভাবে ঘটছে এমন কথায় দ্বিমত পোষণ করেন রংপুরের বিভাগী কমিশনার কে. এম. তারিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এটা অনেকটা সচেতনতার অভাবেই হচ্ছে। আমরা সচেতনা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছি। ত্রাণ হিসেবে শীত বস্ত্র বিতরণ চলছে। ইতোমধ্যে ৪ লাখ কম্বল এ বিভাগে দেওয়া হয়েছে।’ সচেতনতার অভাবে দগ্ধের ঘটনা ঘটলে তার জন্য প্রশাসন কি পদক্ষেপ নিচ্ছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি জেলা প্রশাসকদেরকে সচেতনামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধির জন্য বলেছি।’
আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হওয়ার ঘটনাকে উত্তরাঞ্চলের দুর্যোগে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে জানিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান একুশে টেলিভিশনকে বলেন, ‘২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারিতে আমি দায়িত্ব পাই। তখন ১২ ও ১৩ জানুয়ারি আমি নিজে উপস্থিত থেকে দিনাজপুর, ঠাকুরগাও, নীলফামারী ও পঞ্চগড় ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করি। এসব জেলায় আমরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোকে নিয়ে ঐ অঞ্চলে বন্যা, খড়া, কালবৈশাখী সঙ্গে আগুন পোহাতে গিয়ে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টিকে দুর্যোগের মধ্যে অর্ন্তভূক্ত করি।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান- সংগৃহীত
শীতকালে আগুন পোহাতে গিয়ে এবং অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বৈদুতিক সংযোগে আগ্নিকাণ্ডে ঐ অঞ্চলের মানুষ দগ্ধ হন বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমলে নিয়ে সচেতনতামূলক কাজ করতে জেলা প্রশাসক ও জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোকে আমরা নির্দেশনা দেই। কমিটির সঙ্গে জড়িতদেরকে সরেজমিনে পরিদর্শনের কথা বলি। এ কার্যক্রম চালু আছে।’
তবে শীতবস্ত্রের অভাবে আগুন পোহাতে গিয়ে মানুষ দগ্ধ হচ্ছেন এমন কথা পুরোপুরি ঠিক নয় উল্লেখ করে ডা. এনামুর রহমান বলেন, ‘যাদের কাপড়, জ্যাকেট, সোয়টার আছে তারাও কিন্তু আগুন পোহাতে যান। এখানে অসচেতনতা এবং অসতর্কতা এ দুটোই কাজ করে।’ মন্ত্রণালয় থেকে চলতি শীত মৌসুমে ৪১ লাখ টাকার কম্বল ও শিশুদের পোশাক দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘রাজশাহী, রংপুর, সিলেট ও খুলনা বিভাগের ২০টি জেলায় ৩১ লাখ কম্বল দেওয়া হয়েছে। আমরা শুকনো খাবার দিচ্ছ। শিশুদের জন্য ভিন্ন খাবারও দেওয়া হচ্ছে। এ মাসেও কার্যক্রম অব্যাহত রাখব।’
এদিকে চলতি মাসে দেশের ওপর দিয়ে তিনটি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এর মধ্যে শুরু হয়েছে বৃষ্টিসহ মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ। আর জানুয়ারির শেষে আসছে তীব্র শৈত্যপ্রবাহও। ৬ জানুয়ারির পর একটি, মাসের মাঝামাঝিতে একটি এবং শেষের দিকে আরেকটি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দেশের উপর দিয়ে বয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। তাই এমন অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনা আরও ঘটার আশংকা রয়েই যাচ্ছে।