কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার মামুন মিয়ার সংসার চলে ট্রাক্টর চালিয়ে। অন্য দিনের মতো ১৯ জুলাই ট্রাক্টর নিয়ে কাজে বের হন তিনি। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতার মধ্যে পড়ে যান এ যুবক। দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে জখম করে তাকে। মামুনের ডান হাত মারাত্মক জখম হয়। জীবন বাঁচাতে তার হাত এরই মধ্যে চিকিৎসকরা কেটে ফেলেছেন। হাত হারানোর পর মামুনের মাথায় একটা প্রশ্নই—হাত ছাড়া তিনি বাঁচবেন কীভাবে?
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) চিকিৎসা চলছে মামুনের। চিকিৎসার অর্থ জোগাড়ে এরই মধ্যে গোয়ালের গরু বিক্রি করে দিতে হয়েছে তাকে।
মামুনকে দেখতে গত ২৪ জুলাই ও গতকাল নিটোরে যান এ প্রতিবেদক। গতকাল চাপা কান্নায় বাঁ হাতে ভর দিয়ে হাসপাতালের বিছানায় বসে মামুন বলেন, ‘হাত ছাড়া বাঁচুম কেমনে স্যার?’
মামুনের হাতে ২৫ জুলাই অস্ত্রোপচার করেন রেড ইউনিট-১-এর চিকিৎসকরা। এ ইউনিটের চিকিৎসক ডা. জাহিদ হাসান সিদ্দিক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ধারালো ও ভারী অস্ত্রের আঘাতে মামুনের ডান হাত কয়েক স্থানে ভেঙে যায়। হয় প্রচুর রক্তক্ষরণও। বাম হাতও কব্জির কাছে ভেঙে যায়। তবে ডান হাতের ধমনিতে স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছিল না। ধমনি ও শিরা কেটে গিয়েছিল।’
এ চিকিৎক বলেন, ‘আমরা শুরুতে তার হাত বাঁচানোর চেষ্টা করি। তবে ধমনিতে রক্তের সঞ্চালন স্বাভাবিক না হওয়ায় মাংসে পচন ধরে। চিকিৎসা শুরুর পাঁচদিন পর তার ডান হাত কনুইয়ের ওপর পর্যন্ত কেটে ফেলা হয়। এছাড়া আর উপায় ছিল না। এখন তার অবস্থা স্থিতিশীল। কয়েকদিনের মধ্যে আমরা তাকে ছাড়পত্র দিতে পারব।’
হাত হারানোর ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে গতকাল বণিক বার্তাকে মামুন জানান, ১৯ জুলাই দুপুরের খাবার খেতে তিনি ট্রাক্টর রেখে বাড়ি যাচ্ছিলেন। ভৈরব পৌর এলাকার লক্ষ্মীপুরে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছার পর দুর্বৃত্তরা রামদা দিয়ে কুপিয়ে জখম করে তাকে।
মামুন জানান, তিনি যেখানে হামলার শিকার হন, সেখান থেকে কিছুটা দূরে নিউ টাউন এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে অস্ত্রধারীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলছিল। যারা তাকে কুপিয়ে জখম করেছে, তাদের অনেককেই চেনেন বলে জানান মামুন।
হাসপাতালে মামুনের সঙ্গে আছেন তার স্ত্রীর মৌসুমী আক্তার। আট বছরের ছেলে এবং পাঁচ বছরের মেয়েকে রেখে এসেছেন নানার বাড়িতে। মামুনের শাশুড়িও এসেছেন।
মৌসুমীর ভাষ্য, সরকারি হাসপাতালে খরচ তুলনামূলক কম হলেও প্রতিদিন ওষুধ কিনতেই হাজার হাজার টাকা চলে যাচ্ছে। এরই মধ্যে লাখ টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। টাকা জোগাড় করতে ৮০ হাজার টাকায় গোয়ালের গরু বিক্রি করতে হয়েছে তাদের।
মৌসুমী জানান, তার স্বামীর সঙ্গে কারো শত্রুতা ছিল না। তবু অঙ্গহীন হয়েই বাকি জীবন পার করতে হবে তাকে। মামুনের আক্ষেপ, যে হাতে তিনি এতদিন সংসারের শক্তি হয়ে কাজ করেছেন, ওই হাতই তার নেই। এখন সারা জীবন তাকে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতায় আহতদের অনেকেই এ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। মামুনের মতো গল্প আছে তাদেরও। কেউ হাত হারিয়েছেন; কেউ হারিয়েছেন পা। জীবন হারানোর গল্পও আছে অনেক।
নিটোরের ক্যাজুয়ালটি-২ ওয়ার্ডে অনেক গুলিবিদ্ধ রোগী ভর্তি আছেন। গতকাল এ ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, গুলিবিদ্ধ রোগীদের চোখে-মুখে আতঙ্ক।
গুলিবিদ্ধদের একজন ঢাকা কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মেহেদী সরকার (ছদ্মনাম)। তার বাঁ পায়ে গুলি লেগেছে। হাঁটুর নিচে হাড় ভেঙেছে পাঁচ জায়গায়। পায়ে পচন ধরেছে। এরই মধ্যে পায়ের পচা মাংস কেটে ফেলেছেন চিকিৎসকরা। তিনি বলেন, ‘দোয়া করবেন ভাই। ভয়ে আছি। পাশের বেডের অনেকেরই পা কেটে ফেলতে হয়েছে। ডাক্তার এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি। পায়ে পচন ধরে গেছে। আহত হওয়ার পর থেকে মনে হচ্ছে জাহান্নামের কষ্টে আছি।’
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের হিসাব বলছে, ১৭-২৫ জুলাই পর্যন্ত এ চিকিৎসা কেন্দ্রের জরুরি বিভাগে আসা রোগীর সংখ্যা প্রায় পৌনে দুই হাজার। এর মধ্যে গুলিবিদ্ধ ২৭৫, যাদের মধ্যে ৭৬ জন এখনো চিকিৎসাধীন। সবচেয়ে বেশি গুলিবিদ্ধ রোগী আসে ১৯-২১ জুলাই পর্যন্ত, ২১৪ জন।