কোনো কথাতেই ঠিক থাকতে পারছে না জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ নিবে না বললেও নির্বাচনে অংশ নিল এ জোটটি। জোট থেকে নির্বাচিতরা সংসদে যাবেন না বললেও সাংসদরা সংসদেও প্রবেশ করলেন। এর উপর ফের সরকার বিরোধী কঠোর কর্মসূচির চিন্তা করছে ঐক্যফ্রন্ট। এ নিয়ে ড. কামাল হোসেনসহ জোটের জ্যেষ্ঠ নেতাদের উপর আস্থা রাখতে পারছে না ঐক্যফ্রন্টের শরিকরা। এ অবস্থায় ঐক্যফ্রন্টের ঐক্যের সংকট কাটাতে সোমবার বৈঠকে বসছে জোট নেতারা।
জোটের উপর থেকে দিন দিন আস্থা হারাচ্ছে ঐক্যফ্রন্ট অর্ন্তভূক্ত দলসমূহ। এর মধ্যে ঐক্যফ্রন্ট ছাড়ারও হুমকি দিয়েছে বেশ কয়েকটি শরিক দল। বিশ্লেষকরা বলছেন, ঐক্য না থাকায় ঐক্যফ্রন্ট দিশেহারা হয়ে ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে। তবে ভাঙ্গনের কথা মানতে চাইছেন না ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। তারা বলছেন, রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে সঠিক সময়েই কর্মসূচিতে যাবে এ জোট।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)কে সঙ্গে নিয়ে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল মিলেমিশে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে জোট গঠন করে। প্রথম পর্যায়ে বেশ কয়েকটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে হাতে হাত রেখে পথ চলা শুরু করলেও এখন জোটটি প্রায় ঝিঁমিয়েই পড়েছে। একে অপরের প্রতি বিশ্বাসহীনতা এবং ঐক্য না থাকায় এমনটি হচ্ছে বলে জানান ঐক্যফ্রন্টের শরিক কয়েকটি দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা। এর মধ্যে নিজেদের ভেতর বোঝাপড়া ঠিক করতে ও জোটকে সমুন্নত রাখতে সোমবার (১০ জুন) জোটের শীর্ষ নেতারা বৈঠকে বসবেন। ঐক্যফ্রন্টের মধ্যকার ক্ষোভ প্রশমনে কয়েক দিন ধরেই ভেতরে ও বাইরে বৈঠকের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বলে জানা যায়।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলে নির্বাচন সুষ্ঠ হয়নি দাবি করে ঐক্যফ্রন্ট। জোট থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা সংসদে যাবেন না বললেও শেষ পর্যন্ত কেউই এ কথায় ঠিক থাকতে পারেনি। প্রথমে গণফোরামের দুজন সদস্যের শপথ নেওয়ায় জোটের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তাঁরা। এরপর গেল ২৯ এপ্রিল বিএনপির পাঁচ সাংসদ শপথ গ্রহণ করেন। বিএনপির সাংসদদের শপথ নেওয়ার পর ঐক্যফ্রন্টের বাকি শরিকদের মধ্যে দেখা দেয় তীব্র ক্ষোভ। এতে জোটের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি রাজধানীর শাহবাগে একটি গণজমায়েতের কথা থাকলে তা স্থগিত হয়ে যায়।
সর্বশেষ গত ২৪ এপ্রিল ঢাকায় ঐক্যফ্রন্টের আহবায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের চেম্বারে জোটের এক বৈঠকে নতুন করে কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়ন করতেই পারেনি ঐক্যফ্রন্ট। এরপর আর কোন বৈঠকে বসেননি জোট নেতারা। এক কথায় জোটের নেতারা একে অপরের মুখ দেখা বন্ধ করে দেন। এর মধ্যে জোটের অন্যতম শরিক দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী গত ৯ মে সংবাদ সম্মেলন করে জোট ছাড়ার হুমকি দেন। জোটের মধ্যকার অসংগতি দূর না হলে ৮ জুন জোট ছাড়ার কথা বললেও এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোন ঘোষণা দেননি কাদের সিদ্দিকী।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে মতবিরোধ চরমে এমনটি যেন কোনভাবেই মানতে চাইছেন না গণফোরামের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসীন মন্টু। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে ভাঙ্গন হচ্ছে কিনা এমনটি জানতে চাইলে তিনি একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, ‘এখনই আমি এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। আমরা শীঘ্রই বসছি।’ জোট ছাড়ার বিষয়ে কাদের সিদ্দিকীর বেঁধে দেওয়া সময়সীমার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তিনি তো এখনও বের হয়ে যাননি। তাই বলা যায় না যে জোটে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে।’
অন্যদিকে জোটের প্রধান শরিক বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’র (বিএনপি) অবস্থা বেশ টালমাটাল হওয়ায় জোট নিয়ে পরিষ্কার কোন অবস্থানেই দলটিকে দেখা যায় না। দলটির মধ্যে দ্বৈত নীতি চলছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানের মধ্যে মতানৈক্য চরমে পৌঁছেছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়। তারেকের পক্ষ থেকে প্রথমে সংসদে না যাওয়ার কথা থাকলেও পরে তিনি সংসদে যাওয়ার পক্ষে মত দেন। এরপরও মির্জা ফখরুল ইসলাম সংসদে না গেলেও দলের অন্য সাংসদদের সংসদে পাঠান।
বিএনপির সংসদ সদস্যরা জাতীয় সংসদে গিয়ে আসলে কোন দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন এমন প্রশ্ন দলের নেতাকর্মীদের। সংসদ মানি না এমন কথা বিএনপির পক্ষ থেকে আসলেও শেষ পর্যন্ত সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনেও প্রার্থী দিল দলটি। বগুড়া-৬ সংসদীয় উপনির্বাচনে প্রার্থী দিয়ে নিজেদেরকে চূড়ান্তভাবে দোআঁশলা চরিত্রে উপস্থাপন করেছে বিএনপি। এ অবস্থা দলের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।
এদিকে ড. কামাল হোসেনকে কোনভাবেই যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত প্রধান তারেক রহমান। কিন্তু এরপরও ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির থাকাটা বিস্ময়ের প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। চাপা ক্ষোভ থাকলেও প্রকাশ্যে কিছুই বলতে চান না নেতারা। এর মধ্যে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে মোস্তফা মোহসীন মন্টুকে বাদ দিয়ে রেজা কিবরিয়াকে ঐ পদে আনা হয়েছে। দল বা জোটের মধ্যে কামাল হোসেনের দ্বৈত নীতির বিরোধীতা করায় মোস্তফা মোহসীনকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানান অন্যান্য নেতারা।
রোববার সন্ধ্যায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ফোনে একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, ‘এপ্রিলে খুব দ্রুততার সঙ্গে কিছু বিষয় ঘটে গেছে। এ নিয়ে একটু মনমালিন্য হলেও এখন ঠিক আছে। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিএনপির নির্বাচিতরা সংসদের গিয়েছেন।’ বিএনপির অন্যান্য সাংসদরা সংসদে গেলেও মহাসচিব কেন সংসদে গেলেন না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা রাজনৈতিক কৌশল। রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে মহাসচিব সংসদে যাননি।’
বিভিন্ন দৈনিক ও অনলাইনে ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে বিভিন্ন প্রকার প্রাচরণা হওয়ায় নেতাকর্মীরা এলোমেলো উত্তর দিচ্ছেন বলে দাবি করেন তিনি। ড. কামাল হোসেনকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত প্রধান তারেক রহমান বিশ্বাস করেন না বলে জানা যায় এরপরও ঐক্যফ্রন্টে বিএনপি থাকে কিভাবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা সত্য নয়। বিশ্বাস না করলে বিএনপি ঐক্যফ্রন্টে কিভাবে থাকত। এটা স্বার্থবাজ কিছু এজেন্সির বানানো কথা।’