ঈদ বাড়ি ফেরা হলো না তাদের

রাজধানীর রাস্তা ফাঁকা। মহল্লার পর মহল্লা ফাঁকা। ঈদের দিন আজ বুধবার, সকাল ৭টায় ধানমন্ডি এলাকার খোরশেদ আলম তার ছেলে ও ভাতিজাকে নিয়ে ঈদের নামাজের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। চাকরির সুবাদে তিনি ঢাকার বাইরে থাকেন। পরিবারের সকলের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে নিজ এলাকা ঢাকায় এসেছেন। তার বন্ধু সালাউদ্দিন আহমেদ শ্যামলীতে নিজের ফ্লাট ও ব্যবসা রেখে বাড়িতে গেছেন মা, বাবা, ভাই, বোনসহ সকলের সঙ্গে ঈদ উৎসব উদযাপন করতে। খোরশেদ সাহেব যখন ধানমন্ডির একটি ঈদগাহে ঢুকছিলেন ঠিক সেই সময়ে ঈদগাহের গেটে কয়েকজন পোশাকধারী পুলিশ সদস্য অস্ত্র উঁচিয়ে নিরাপত্তার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন।

মানুষের নিরাপত্তার জন্য নিজ স্বজনদের নিয়ে তাদের ঈদ উদযাপন আর হচ্ছে না। ৪০ উর্দ্ধো এক পুলিশ কনেস্টবলের দিকে এগিয়ে গেলে নাম জানা গেল আব্দুল আলীম। ঈদে নিজের পরিবারের বাইরে ঈদ উদযাপন করার বিষয়ে কথা বলতে চাইলে প্রথমে তিনি মুখে অম্লান হাসি দিয়ে বললেনে, ‘এটা তো উদযাপন নয়। সুন্দর উদযাপন নিশ্চিত করা। বাস্তবতা তো বুঝি। সারা বছর কাজে থাকতে হয়। জরুরী পরিস্থিতি ছাড়া ছুটি মেলা কঠিন। তবে ঈদে মনটা একটু খারাপ হয়, মন চায় পরিবারের সঙ্গে থাকতে কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠে না।’

আলীমের সঙ্গে কথা বলার সময় দাড়িঁয়েছিলেন মঈন নামে ২৫ উর্দ্বো পুলিশ সদস্য। তার চোখটা ভিজে গেলো। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আর কথা বলা গেল না। হয়ত সে এই ঈদের সকালে মায়ের কথা ভাবছে, হয়ত ভাবছে ছোট ভাই ও বোনের কথা। যে বোন মাথায় লাল ফিতার ঝুটি করে ভাইয়ের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে হাটে যাওয়ার আবদার করবে। তা আর হলো কোথায়?

পুলিশের অনেক সদস্যরা নগরীসহ পুরো দেশের নিরাপত্তার জন্য এই মহা উৎসবে বাড়ি ফিরতে পারেননি। হয়ত অন্য সময় বাড়ি ফিরতে পারবেন তবে পরিবার, বন্ধু ও এলাকাবাসীর সঙ্গে ঈদ উৎসব হলো না। নিরাপত্তার কারণে ঈদের জামাতের শেষ মুহূর্তে কোন রকম দাড়িঁয়ে নামাযটা পড়েছেন তারা, মোনাজাত করেছেন বুকে বা পিঠে অস্ত্র ঝুলিয়ে। নিরাপত্তা তো তাদেরকেই দিতে হবে।

তারা নিরাপত্তার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এটা তাদের দায়িত্ব। মহান এ দায়িত্ব তারা পালন করছেন ঠিকই তবে মনের মধ্যে সুপ্ত অপ্রাপ্তি থেকেই গেল। তাদেরও মন চাইছে গাঁয়ে বন্ধুদের সঙ্গে যে মাঠে খেলাধুলায় শৈশব কেটেছে সেই মাঠে আবার ফিরে যেতে, সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে নদী পাড়ে আড্ডা দিতে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে একটি গ্রুপে ঈদে দায়িত্বরত কয়েকজন পুলিশ সদস্যের ছবি আপলোড করে ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ‘পাঞ্জাবিটা ট্রাংকে রয়ে গেছে, জামাটাও রয়ে গেছে, এর মধ্যে পুলিশের আনন্দ হলো মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া। শহরের খালি বাড়ি, ব্যাংক, সরকারি স্থাপনা, পার্ক, ঈদের জামাত, ভি ভিআইপিদের নিরাপত্তা দেওয়া। ঈদে বাড়ির পথে যাত্রাকারী সকলের যাতায়াত নিরাপদে ও সুন্দরভাবে নিশ্চিত করা। ডিউটি নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে কাটছে পুলিশের ঈদ আনন্দ।’

এমদাদুল বারি শাওন নামের বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের এক শিক্ষা কর্মকর্তা তার ব্যক্তিগত ফেইসবুক প্রফাইলে লিখেছেন, ‘যাদের আনন্দ ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের আনন্দ উপভোগ।’

পুলিশ সদস্যদের মত ঈদে বাড়ি ফেরা হয়নি অনেক সংবাদকর্মীর। বিশেষ করে টেলিভিশন স্টেশন ও অনলাইন পোর্টালের সংবাদিকদের অনেকেই বাড়ি ফিরতে পারেননি। দুই ঈদে ছুটি পাওয়া যাবে না এই শর্তে এক ঈদে ছুটি মেলে। কিন্তু এক ঈদে আনন্দ করলে অন্য ঈদে আনন্দ করতে মন চায় না এমন তো নয়। উৎসব তো আর বেঁধে রাখা যায় না। মুখে হাসি দেখিয়ে বাস ও রেল স্টেশন, লঞ্চ ঘাটে বাড়ি ফেরা মানুষদের সংবাদ সংগ্রহে ছুটেন সাংবাদিকরা।

বাড়ি ফেরা মানুষদের মত তাদেরও ইচ্ছে হয় বাড়ি ফিরতে কিন্তু বাস্তবতার কঠোরতায় আর বাড়ি ফেরার কথা মুখে আসে না। জাতীয় ঈদগাহের সামনে দেখা হয় বাংলা নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক তামিম মজিদের সঙ্গে। তিনি ঈদের জামাতের সংবাদ সংগ্রহে এসেছেন এ ময়দানে। জিজ্ঞাসা করতেই চওড়া হাসি দিয়ে বলেন, ‘ঈদে বাড়ি ফিরতে কার না মন চায়। কিন্তু দুই ঈদে তো আর যাওয়া হয় না। ঈদে সকলে বাড়ি গেলে তো মানুষ খবর জানতে পারবে না।’

সত্যিই সকল সাংবাদিক যদি ঈদের ছুটিতে বাড়ি যেতেন তো দেশ-বিদেশের কোন খবরই পেত না জনগণ। নিরবিচ্ছিন্নভাবে মানুষের ঘরে খবর পৌঁছে দিতেই এসব সাংবাদিকরা নিজ পরিবার ছেড়ে এ দিনেও খবরের পিছনে ছুটছেন। ঈদের সময় সপ্তাহজুড়ে অনুষ্ঠান দেখবেন দেশবাসী, পাবেন সব মুহূর্তের খবর। টিভি খুললে বা অনলাইন পত্রিকায় গেলে সহজেই পাওয়া যাবে সংবাদ বা অনুষ্ঠান। তবে এ অনুষ্ঠান বা সংবাদের পিছনে যে রয়েছে শত শত কর্মীর সুখের আত্মত্যাগ।

এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মী ও গাড়ি চালকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ রয়ে গেছেন অন্যের ঈদ যাত্রা ও ফিরে আসা নিরাপদ করতে। আপাতদৃষ্টিতে এই ত্যাগ হয়ত বেশি কিছু নয়। তবে এদের হৃদয়ের অনুভূতি বেশ গভীর।

সরকারী একটি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি চালক আবুল কাশেম। অবিবাহিত আবুল কাশেমের বাবা নেই। গ্রামের বাড়িতে মা ও ভাই আছেন। ঈদের দিনে মায়ের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেন তিনি, খোঁজ খবর নেন। মায়ের জন্য যে শাড়িটা পাঠিয়েছিলেন তা তিনি পরিধান করেছেন কিনা তা জানতে চান কাশেম। ওপাশ থেকে মা কি উত্তর দিলেন তা শুধু আবুল কাশেমই জানেন। তাকে নীড়হারা পাখির মতই দিশেহারা দেখাচ্ছিল, চোখ থেকে নিরবে নোনাপানির স্রোত বইছিল।

ঈদ। দুই অক্ষরের এক শব্দের মাঝে কত শত আনন্দ, বিশাল প্রাপ্তির আকাঙ্খা, পরিবার ও পরিজনের সঙ্গে মহা মিলনমেলা। সেই উৎসবের সঙ্গেও মিশে আছে অনেক অপ্রাপ্তি, আশা ও বেদনা।

Share the Post: