পারিবারিক দ্বন্দ্বে ঝাপসা পথে জাতীয় পার্টি

দলকে আবার ক্ষমতায় দেখতে চেয়েছিলেন হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ। কিন্তু তার সেই চাওয়া পূরণ হয়নি। তার অনুপস্থিতিতে জাতীয় পার্টিতে চলছে পারিবারিক দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্ব এতটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে যে দল ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। দলের মধ্যে এমন দ্বন্দ্ব জাতীয় পার্টির ভবিষৎ ভালো হবে না বলে মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পরও নাটকীয়তার বৃত্তেই আটকে আছে সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি৷

এখন বিরোধী দলীয় নেতা হওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জিএম কাদের) এবং রওশান এরশাদ। গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের স্পিকারের কাছে নিজেকে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে ঘোষণা করার অনুরোধ জানিয়ে দলীয় প্যাডে চিঠি পাঠিয়েছেন জিএম কাদের। এরপর বুধবার স্পিকারের প্রতি পাল্টা এক চিঠিতে কাদেরে বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দলের কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ। এ নিয়ে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও সংসদ সদস্যরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। বিরোধী দলীয় নেতার আসনে জিএম কাদেরকে চায় এক পক্ষ অন্য পক্ষ চায় রওশন এরশাদকে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তারা এখন তাকিয়ে আছেন সরকারের দিকে, সরকারের সবুজ সংকেতই নির্ধারণ করবে বিরোধী নেতা।

এদিকে পার্টির শীর্ষ পদ নিয়ে টানা হেঁচড়া হলেও রওশন বা জিএম কাদের উভয় পক্ষই মসিউর রহমান রাঙ্গাকে মহাসচিব হিসেবে দাবি করছেন। তবে রওশন বা জিএম কাদের কার প্রতি তার সমর্থন আছে সেটা পরিষ্কার করেননি রাঙ্গা।

বৃহস্পতিবার মুঠোফোনে একুশে টেলিভিশনের সঙ্গে আলাপকালে মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ‘আমাকে কর্মীরা ভালোবাসে বলেই সবাই চাইছে। আমি সব সময়ই কর্মীদের খবরাখবর নিতে চেষ্টা করেছি। তাদের জন্য কাজ করতে চেষ্টা করেছি বলে আমার জনপ্রিয়তা আছে।’

বিরোধী দলের নেতা হওয়ার জন্য কে দলীয়ভাবে যোগ্য এমন প্রশ্ন করলে তিনি সদুত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যান। রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরের মধ্যে দ্বন্দ্ব কি কারণে চলছে এমনটি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আসলে তেমন কোন কারণে হচ্ছে না। কিছু নেতাকর্মী তাদের মাঝখানে ঢুকে পড়ায় এমনটি হয়েছে। স্বার্থবাদী কিছু লোক সব সময়ই ঝামেলার সৃষ্টি করে।’ এ দ্বন্দ্ব স্থায়ী হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে রঙ্গা বলেন, ‘তেমনভাবে স্থায়ী হবে না। সকলকে নিয়ে বসতে পারলে বিষয়টি সুরাহা হবে।’

জিএম কাদেরের প্রেস সেক্রেটারি ও জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য শুনীল শুভ রায় এক সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘দলের সংসদ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠরা যার পক্ষে থাকবেন, তিনিই বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচিত হবেন। আমরা গতকাল ১৫ জন সংসদ সদস্যের স্বাক্ষর নিয়ে জিএম কাদেরকে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে নিয়োগ দিতে স্পিকারকে চিঠি দিয়েছি।’

রওশনপন্থী প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, ‘সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচিত হবেন সংসদীয় বোর্ডের সভায়। এখনও দলের সংসদীয় বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। আর সংসদ উপনেতা হিসেবে রওশন এরশাদ সংসদীয় বোর্ডের সভা ডাকবেন। ফলে জিএম কাদেরের চিঠির বৈধতা নেই। এ জন্য তার চিঠি গ্রহণ না করতে স্পিকারকে চিঠি দিয়েছি।’

গত ১৪ জুলাই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর ৪ দিন পর ১৮ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে জিএম কাদেরকে জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেন দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা। এরপর ২৩ জুলাই জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান হিসেবে অস্বীকার করে বিবৃতি দেন রওশন এরশাদসহ দলের সাত জন সংসদ সদস্য ও দুই জন প্রেসিডিয়াম সদস্য। পরবর্তী সময়ে এরশাদের চেহলাম উপলক্ষে কয়েকটি মিলাদ মাহফিলে একসঙ্গে দেখা যায় রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরকে।

অন্যদিকে এরশাদের মৃত্যুতে রংপুর-৩ আসনের উপ-নির্বাচন নিয়েও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব রয়েছে জাপায়। রওশনপন্থীরা এরশাদ পুত্র রাহগির আল মাহিরকে (সাদ এরশাদ) এ আসনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে চাইলেও কাদেরপন্থীরা চান ভিন্ন কাউকে।

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য তাজ রহমান একুশে টেলিভিশনকে বলেন, ‘এরশাদ একাদশ সংসদ নির্বাচনের পরে বিরোধী দলের নেতা হওয়ার জন্য স্পিকারকে চিঠি দিয়েছিলেন। জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হওয়ায় চেয়ারম্যান এরশাদকে বিরোধী দলের নেতা করেই স্পিকার গেজেট প্রকাশ করেন। জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিতরা বিরোধী দলের সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন। তার আবর্তমানে জিএম কাদের জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হবেন এবং বিরোধী দলের নেতা হবেন এমনটি স্পিকারকে চিঠিতে জানিয়ে যান এরশাদ। সে ধারাবাহিকতায় আগামী কাউন্সিল হওয়া না হওয়া পর্যন্ত জিএম কাদের বিরোধী দলের নেতা থাকবেন।

অন্য দিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদের সম্মতি নিয়ে সংসদ বা বিরোধী দলের নেতা হতে হয়। সেখানে ১৫ সদস্যের স্বাক্ষরে রওশন এরশাদকে বিরোধী দলের নেতা করার কথা বলা হয়।’ দলের নেতাদের প্রতি হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এ দ্বন্দ্বটা দলীয় নয়, দ্বন্দ্বটা পারিবারিক। রাজনীতি হলো উৎসর্গের একটা বিষয়। দেশের স্বার্থে দলের স্বার্থে উৎসর্গ করতে হয় অনেক কিছু।’

এদিকে এরশাদের অনুপস্থিতিতে তার দলে যে বিরোধ দেখা দিয়েছে তাকে দলের ভবিষৎ ভালো হবে না বলে মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। আদৌ জাতীয় পার্টির প্রাসঙ্গিকতা থাকবে কিনা তা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। যদিও আশির দশকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জেলেও যেতে হয়েছে এরশাদকে। পরে তিন দশকই ক্ষমতার কাছাকাছি ছিলেন এরশাদ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দলের সঙ্গে সময়ে সময়ে বেশ সখ্যতা গড়েছিলেন তিনি। দেশে এ দুই দলের কাছে নিজের গুরুত্ব কতটুকু ধরে রাখতে পারবে এমনটি ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জাতীয় পার্টির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন’র (বিএফইউজে) সভাপতি মোল্লা জালাল বলেন, ‘পার্টি যদি পার্টি হয় তখন নিয়ম শৃঙ্খলা থাকে কিন্তু যদি প্রপার্টি হয়ে যায় তাহলে সেটা আর পার্টি থাকে না। এরশাদ যখন দল চালিয়েছেন সেটি হলো নিয়োগ প্রক্রিয়া। সে ধারাবাহিকতায়ই চলছে। সবাই বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কিন্তু তারা কখনওই এক সঙ্গে আলোচনায় বসেন না। পারিবারিক দ্বন্দ্বে পার্টি এমন বিভক্ত হয়েছে।’

এরশাদকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২২টি আসন পায়। এরশাদ হন বিরোধী দলীয় নেতা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক রওনক জাহান এক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক মেরুকরণ এখন অন্য চেহারা নিচ্ছে। জাতীয় পার্টি তো আদর্শভিত্তিক কোন পার্টি ছিল না। এটা পুরোটাই এরশাদের ব্যক্তি ইমেজ নির্ভর পার্টি ছিল। তার অবর্তমানে পার্টিটা টিকে থাকবে কিনা, সেটাই এখন সন্দেহের মধ্যে পড়ে গেলো।’ বিশ্লেষকরা মনে করেন, জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব পারিবারিক দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে রয়েছে এবং সেজন্যই এর ভবিষ্যত নিয়ে তাদের সন্দেহ আছে।

Share the Post: