দেশে যেসব ক্যাসিনো মেশিন ও সরঞ্জামাদি আমাদানি হয়েছিল তা বৈধভাবেই আমদানি করা হয়েছে। এতে সরকার রাজস্বও পেয়েছে। তবে এ সব আমদানি করা যাবে কিনা তা নিয়ে আইনে স্পষ্ট কোন বিধান না থাকায় এমনটি হয়েছে বলে মনে করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
খেলনা সমগ্রীর কথা বলে এসব আনা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আইনে ক্যাসিনোর সরঞ্জাম আমদানিতে স্পষ্ট কোন নির্দেশনা নাই। তাই পরস্পরের যোগসাজোসে এসব আমদানি হয়েছে খেলনা হিসেবেই। অপরদিকে জুয়াবিরোধী একটি আইন থাকলেও রাজধানীতে গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন ক্রীড়া ক্লাবের জুয়ার আসর থেকে আটক শতাধিক ব্যক্তির কারও বিরুদ্ধেই এ আইনের আওতায় ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। উপরন্তু অর্থ পাচার, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক দ্রব্য আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
জানা যায়, ক্যাসিনো সরঞ্জাম দেশে বৈধভাবে আমদানি করা হয়েছে। দেশে ক্যাসিনো অবৈধ হলেও শুল্ক আইনে ক্যাসিনো সরঞ্জাম আমদানিতে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। দীর্ঘ দিন ধরে ক্যাসিনো যন্ত্রের সরঞ্জাম আমদানির সঙ্গে সঙ্গে করও পাচ্ছে সরকার। ক্যাসিনোর জন্য ব্যবহৃত চিপস, কয়েন, টেবিলগুলি আমদানির বাণিজ্যিক ঘোষণায় জুতা, বিনোদন এবং ক্রীড়া পণ্য সম্পর্কিত সরঞ্জাম হিসাবে দেখিয়ে দেশে আনা হয়েছে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর (সিআইআইডি) পরিচালিত তদন্তে বিষয়টি উঠে এসেছে।
ক্যাসিনো সরবরাহে জড়িত থাকার অভিযোগে গোয়েন্দা বিভাগ সাতটি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে তদন্তে নেমেছে। তবে শুল্ক বিভাগ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড অবৈধ ক্যাসিনোর সরঞ্জাম আইনী উপায়ে আমদানির ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।
সিআইআইডি’র তথ্য অনুসারে, ২০০১ সালের ডিসেম্বরে এএম ইসলাম অ্যান্ড সন্স লিমিটেড চীন থেকে ৭০ টি ক্যাসিনো চিপ আমদানি করেছে। এ প্রতিষ্ঠানটি সাউথ ইস্ট ব্যাংকের সাথে ৮৮.৮৮ লক্ষ টাকার ঋণপত্র বা এলসি খোলে সে দেশে টাকা পাঠায়। আমদানি কারক এ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এনবিআরকে রাজস্ব, পরিপূরক শুল্ক এবং মূল্য সংযোজন কর হিসাবে মোট ৪ হাজার ১ শত ৮৮টাকা দেওয়া হয়।
আমদানির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি তার বাণিজ্যিক ঘোষণা ছাড়াই এইচএস কোড: ৬৪০৬৯০০ ব্যবহার করে ক্যাসিনো চিপগুলি আমদানি করে। তবে এ পণ্যগুলোর সম্পর্কে বলা হয়, এগুলো জুতা শিল্পের পণ্য। সিএন্ডএফ এজেন্ট কাওসার কার্গো কমপ্লেক্স লিমিটেডের এক কর্মকর্তা বলেছেন, তারা কোনও নির্দিষ্ট এইচএস কোড না পাওয়ায় অন্যান্য জুতার কাঁচামাল হিসাবে দেখানো ক্যাসিনো চিপগুলি আমদানি করেছেন।
ঢাকা শুল্ক হাউস কমিশনার মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘বিদ্যমান আইন অনুসারে, পণ্যটির সরাসরি কোনও বিবরণ নেই, এটি সম্পর্কিত পণ্য হিসাবে দেখিয়ে আমদানির অনুমোদন দেওয়া হতে পারে। ক্যাসিনো চিপের আমদানিতে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চট্টগ্রাম রাজস্ব কর্মকর্তাদের মতে, এইচএস কোড ৯৫০৪.৫০.০০ ব্যবহার করে ক্যাসিনো যন্ত্রগুলি আমদানি করা হয়। গত পাঁচ বছরে মোট ৫১ টন এ জাতীয় সরঞ্জাম আমদানি করা হয়েছে এবং সরকার ৬৩৬৩ লক্ষ টাকা রাজস্ব পেয়েছে।
চট্টগ্রামের শুল্ক হাউজের কমিশনার ফকরুল আলম বলেছেন, ‘সরকারের আমদানি নীতিমালা অনুসারে ক্যাসিনো পণ্য আমদানিতে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘ক্যাসিনো ব্যবসা বাংলাদেশে সম্পূর্ণ অবৈধ। এনসিআর ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত লোকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। কোনও কাস্টমস কর্মকর্তা ক্যাসিনো সরঞ্জাম আমদানিতে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেলে এনবিআর তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবে বলে জানান তিনি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড’র (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, ‘এসব আমদানিতে আইনে কিছু বলা না হলেও কি আমদানি করা যাবে আর কতটুকু তা বলা আছে। এখানে কেউ কোন অন্যায় করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যেতে পারে। অনেক কিছুই তো বৈধ যেমন তাস কিন্তু তা কতটুকু এবং কিভাবে তা নিশ্চয়ই বলা আছে। সরকারের রাজস্ব ও শুল্কে ফাঁকি দেওয়া হলো কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। বলা হলো এক আর আনা হলো এক এমন বিষয় হলে অবশ্যই তা অপরাধ। অনেক খেলাই অবৈধ নয় কিন্তু এ খেলার মাধ্যমে কোন অপরাধ সংঘঠিত হলে সেটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।’
ক্যাসিনোর সরঞ্জামাদি আমদানিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দায়ভার এড়াতে পারেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তারা যদি নিয়মানুযায়ী সব করে থাকেন তাহলে কিছু করার নেই। এখানে অবৈধ টাকার লেনদেন হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। কর ফাঁকি দেওয়া হলো কিনা বা যে পরিমান পণ্য আনার কথা তার বেশি আনা হলেও ছাড় দেওয়া হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। এতে কোন কর্মকর্তা জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে আনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।’
এদিকে ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের জুয়ার আইনে কোন মামলা দেওয়া হয়নি। দেশে পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট, ১৮৬৭ নামের যে আইনটি রয়েছে সেটি রাজধানীতে প্রয়োগ করার সুযোগ নেই বলে জানা যায়। ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ এর ৯২ ধারায় প্রকাশ্যে জুয়া খেলার জন্য মাত্র ১০০ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে। ‘দুর্বল’ আইনের কারণেই আটকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে প্রথম অভিযান চালায় র্যাব। এখানে জুয়া-ক্যাসিনো চালানোয় ক্লাবের কর্ণধার যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে তার গুলশানের বাসা থেকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়। এ দিন মতিঝিলে ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ও গুলিস্তানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবেও অভিযান চালান হয়। এসব অভিযানে জুয়া-ক্যাসিনোর বিপুল সরঞ্জাম, টাকা জব্দের পাশাপাশি ১৪২জনকে আটক করা হয়।
যুবলীগ নেতা খালেদের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও মুদ্রাপাচার আইনে মামলা হয়েছে। এছাড়া আটক অন্যদের ছয় মাস থেকে এক বছর মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। মাদক রাখা ও সেবনের অভিযোগে তাদের এই সাজা দেওয়া হয়েছে বলে জানান এক র্যাব কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের মিডিয়া উইংয়ে পরিচালক সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, ‘আইনি যে প্রক্রিয়া, সেটা নেওয়া হয়েছে। একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এসব অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ম্যোজিস্ট্রেট ক্লাবগুলো সিলগালা করে দিয়েছেন। আইনি প্রক্রিয়া এখনও চলছে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ অনুযায়ী আটকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কেন নেওয়া হল না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বিষয়টি ভালো বলতে পারবেন।’ তবে একুশে টেলিভিশনের পক্ষ থেকে ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের সঙ্গে কথা বলতে তার সরকারী মুঠোফোনে যোগাযোগ করে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
গত রোববার মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, আরামবাগ এবং দিলকুশা ক্লাবে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ জুয়ার সামগ্রী জব্দ করে পুলিশ। একটি ক্লাবে মদ এবং এক লাখ টাকাও পাওয়া যায়। এসব ক্লাব থেকে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তাই কারও বিরুদ্ধে মামলাও হয়নি।
র্যাবের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলছেন, ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশের ৯২ ধারায় যে জরিমানার কথা বলা হয়েছে তা খুবই নগন্য। এই ধারায় আটকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে তারা দ্রুত আদালত থেকে ছাড়া পেয়ে যাবে। আইনের মধ্যে রেখেই অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিষয়টি চিন্তা করেই তাদের নামে বিভিন্ন মামলা দেওয়া হয়েছে।