উপেক্ষিত জনস্বাস্থ্য সমস্যা: শীতে পোহাতে গিয়ে মৃত্যু ঘটছে, প্রতিরোধে নজর নেই

  • প্রতি শীত মৌসুমেই আগুন পোহাতে দগ্ধ হচ্ছে মানুষ।
  • বেশি ঘটছে উত্তরাঞ্চলে, অধিকাংশই নারী ও শিশু।
  • এই দগ্ধ ও মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান নেই কোথাও।

উত্তরাঞ্চলে প্রতিবছর শীত মৌসুমে আগুন পোহাতে গিয়ে অসাবধানতায় অনেক মানুষ দগ্ধ হচ্ছে। তাদের অনেকে মারাও যাচ্ছে। যারা বেঁচে যাচ্ছে, তাদের কেউ কেউ দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যায় ভুগছে।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, প্রতিবছর এ ঘটনা ঘটলেও তা প্রতিরোধে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য হলেও এটি অবহেলিত জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবেই থেকে গেছে। আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হওয়া মানুষ নিম্নবিত্তের। তাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে যেতেও দেরি করে। এতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, বিশ্বে বছরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ১ লাখ ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়; যার বেশির ভাগই ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। এর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে।

সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা বলছেন, বাংলাদেশে বছরে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ বিভিন্নভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়। তবে শীত নিবারণে আগুন পোহাতে গিয়ে কতজন দগ্ধ হয়, তার সঠিক হিসাব নেই। তবে এমন ঘটনা বেশি ঘটছে উত্তরাঞ্চলে। আগুনে পোড়া রোগীদের অধিকাংশই ঘটনার ২৪ ঘণ্টা কিংবা তার বেশি সময় পর হাসপাতালে আসে।

উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, রংপুর ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে এসব হাসপাতালে অন্তত ৫০০ জন ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে শীতে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ রোগীও আছে। আছে অগ্নিশিখায় পোড়া, বাষ্পে পোড়া, বিদ্যুতায়িত হয়ে পোড়া, রাসায়নিকে দগ্ধ ও বজ্রপাতে দগ্ধ।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র বলেছে, সেখানে গত তিন মাসে ৩২২ জন দগ্ধ রোগী ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন পুরুষ, পাঁচজন নারী ও একটি শিশু আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হয়েছে। তাদের চারজনই মারা গেছে। বাকি তিনজনের পোড়া ক্ষত বেশি হওয়ার ঢাকায় পাঠাতে হয়েছে।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আজকের পত্রিকাকে জানায়, শীতে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ রোগী চলতি মৌসুমে প্রথম ভর্তি হয় ১০ ডিসেম্বর। এ কারণে দগ্ধ ৮ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। তাদের দুজন মারা গেছে। বর্তমানে পাঁচজন ভর্তি রয়েছে। একজনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বতন্ত্র বার্ন ইউনিট বা বিভাগ না থাকায় দগ্ধ রোগীদের ভর্তি করা হয় সার্জারি বিভাগগুলোতে। গত তিন মাসে শিশু সার্জারি বিভাগে ভর্তি হয়েছে অগ্নিদগ্ধ ৪৯টি শিশু। পুরুষ সার্জারি এবং নারী সার্জারি বিভাগে ভর্তি হয়েছে যথাক্রমে ৩১ ও ৩৮ জন দগ্ধ রোগী।

নেদারল্যান্ডসভিত্তিক বৈজ্ঞানিক সাময়িকী এলসেভিয়ারে গত আগস্টে ‘বার্ন ইনজুরিস অ্যান্ড অ্যাকুট বার্ন ম্যানেজমেন্ট ইন দ্য রুরাল অ্যারিয়াস ইন নর্দান বাংলাদেশ: আ হাউসহোল্ড সার্ভে’ শিরোনামে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার ওপর একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়, ৫৫ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তাঁদের পরিবারের অন্তত একজন কোনো না কোনোভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। অগ্নিদগ্ধের ৪১ শতাংশ কারণ উন্মুক্ত স্থানে আগুন। দগ্ধ ৩০ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা নেয়নি; যার বড় কারণ অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক পরিসংখ্যান ও পর্যবেক্ষণ বলছে, গত পাঁচ বছরে হাসপাতালটিতে ২ হাজার ৮৮৮ জন অগ্নিদগ্ধ রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। তারা মূলত গ্রামাঞ্চল থেকে এসেছিল। যাদের বেশির ভাগ নিম্ন আর্থসামাজিক পরিবারের সদস্য এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পায়নি।

দীর্ঘদিন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালনকারী সহযোগী অধ্যাপক এম এ হামিদ পলাশ (সম্প্রতি জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে বদলি) আজকের পত্রিকাকে বলেন, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, রংপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধাসহ অন্তত ১০ জেলার পোড়া রোগী চিকিৎসার জন্য আসে। তাদের মধ্যে শিশু, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও নারীর সংখ্যা বেশি। তাদের বেশির ভাগ দরিদ্র। দগ্ধ হওয়ার আট ঘণ্টার মধ্যে তারা হাসপাতালে আসে না। সাধারণত শরীরের ৩০ শতাংশের বেশি পুড়ে গেলে মেজর বার্ন বলা হয়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু না করা গেলে এমন রোগীকে বাঁচানো কঠিন। শিশু ও বৃদ্ধদের আরও কম সময়ে হাসপাতালে আনতে হবে। অনেক পোড়া রোগীর কিডনি, শ্বাসনালিসহ শরীরের অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে যায়। তিনি বলেন, উত্তরাঞ্চলের মানুষ একটু তাপ নিতে উন্মুক্ত স্থানে আগুন জ্বালায়। তারা যে কাপড় পরে, তাতে আগুন লাগলে দ্রুত ছড়ায়।

উত্তরাঞ্চলে শীতে আগুন পোহানো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চাহিদায় পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সমাজ ও নৃবিজ্ঞানীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসান এ শাফী আজকের পত্রিকাকে বলেন, শীতে আগুন পোহাতে মানুষ উন্মুক্ত স্থানকে বেছে নেয়। চারপাশে পাতা, খড় ইত্যাদি দিয়ে আগুন জ্বালায়। বাতাসের গতি তারা বুঝে উঠতে পারে না। এতে আগুনের ফুলকি গিয়ে তাদের জামাকাপড়ে লাগে। তারা আগুন পোহাতে আসে মূলত চাহিদার কারণে।

রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের গত এক মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যেসব দগ্ধ রোগী মারা গেছে, তারা দেরিতে চিকিৎসা নিতে এসেছিল। পোড়ার ক্ষত বেশি বা সংক্রমণের কারণে তাদের মৃত্যু হয়নি।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, দেশে শীতকালে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হওয়ার বিষয়টি উপেক্ষিত। স্বাস্থ্য বিভাগ এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রতিবেদন তৈরি করেনি। ফলে বছরে কত মানুষ আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে, তা জানা যায় না। প্রকৃত অবস্থা জানা গেলে যথাযথ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, চিকিৎসা সুবিধা ও সচেতনতা তৈরিতে কাজ করা যেত।

জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, যেগুলো নিয়মিত ঘটে না, সেগুলোই অবহেলিত জনস্বাস্থ্য সমস্যা; যা হঠাৎ মারাত্মক আকার ধারণ করে। ফলে এ সম্পর্কে তেমন আলোচনা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তবে ক্ষতির মাত্রা বেশি। তিনি বলেন, উন্মুক্ত স্থানের বদলে কনটেন্ট ফায়ার (বাধাপ্রাপ্ত স্থানে আগুন) হলে এমন ঘটনা ঘটত না। এ ছাড়া অগ্নিদগ্ধ হলে রোগীরা শুরুতে হাসপাতালে আসে না, ক্ষতিকর মলম লাগায়। অথচ এগুলো সহজে প্রতিরোধ করা যায়। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠকর্মীদের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো যায়। বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), মসজিদ, মাদ্রাসা, বিদ্যালয়ের মাধ্যমে কাজ করা যায়।

উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তম সরকারি হাসপাতাল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭০ শয্যার বার্ন ইউনিট রয়েছে। হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহাম্মদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, এ ধরনের ঘটনার শিকার মানুষ মূলত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর। যেসব রোগী মারা যায়, তারা দেরিতে হাসপাতালে আসে। শুরুতে বিভিন্ন মলম লাগায়; গ্রাম্য চিকিৎসক, কবিরাজের কাছে যায়। পরিস্থিতি খারাপ হলে হাসপাতালে আসে। এর মধ্যে দেখা যায়, অনেক অঙ্গ অকেজো হয়ে গেছে।

Share the Post: