কিশোরগঞ্জ সদরের চৌদ্দশত ইউনিয়নের চৌদ্দশত গ্রামের চার বছরের শিশু রাফিউল আলম রিফাত। ২০১৭ সালের শুরুতে জন্ম হলেও শিশুটির জন্মনিবন্ধন করা হয়নি। ফলে সরকারের হিসাবের বাইরেই রয়ে যাচ্ছে শিশুটি। রিফাতের মতো কিশোরগঞ্জে পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের জন্ম নিবন্ধনের হার ২০ শতাংশের কম।
ঢাকার বাসিন্দা মাইনুল আলম বেসরকারি চাকরি করেন। তার দ্বিতীয় সন্তান ইতিশা আলমের বয়স তিন বছর। সচেতন হয়েও মাইনুল মেয়ের জন্মনিবন্ধন না করার বিষয়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, যখন প্রয়োজন পড়বে তখনই মেয়ের জন্মনিবন্ধন করব। নিবন্ধনটা নিজ এলাকায় রংপুর থেকে করব ভাবছি। বছরে কয়েকবার যাওয়া হলেও মেয়ের জন্মনিবন্ধন করা হয়নি।
দেশের অন্যান্য জেলায় জন্মনিবন্ধনের চিত্র প্রায় একই রকম। জন্মনিবন্ধন না হওয়ায় দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সের প্রায় এক কোটি শিশু সরকারি হিসাবের বাইরে রয়েছে। ফলে তারা স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মৌলিক অধিকার, আইনি সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) একটি গবেষণায় বলছে, দেশের পাঁচ বছরের শিশুদের ৪০ শতাংশের জন্মসনদ রয়েছে, ১৭ শতাংশ নিবন্ধন করলেও এখনো জন্মসনদ পায়নি। ফলে বাকি ৪৩ শতাংশ জন্মনিবন্ধনের বাইরে থেকে যাচ্ছে। শিশুদের বড় এ অংশ সরকারি হিসাবের বাইরে থাকায় জাতীয় নীতির পরিকল্পনা ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের এ সংস্থা। গত বছরের ডিসেম্বরে ‘দ্য বাংলাদেশ মাল্টিপাল ইনডিকেটর ক্লাসটার সার্ভে (এমআইসিএস)’ শিরোনামে একটি গবেষণায় বিষয়টি উল্লেখ করে ইউনিসেফ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণাটি করে তারা।
স্থানীয় সরকার বিভাগের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ১৭ কোটি ৫৯ লাখ ৮৪ হাজার ৩৬৭ জনের জন্মনিবন্ধন করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ বছরের নিচে শিশুর সংখ্যা ১ কোটি ৬৭ লাখ ৭ হাজার ৭০০। সরকারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঠিক সময়ে জন্মনিবন্ধন না হওয়ার পেছনে তাদের তেমন কিছু করার নেই। বিষয়টি শিশুর অভিভাবকের ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করে। যথাসময়ে জন্মনিবন্ধন করার জন্য সরকার এখনো চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি বলে জানান তারা।
পাঁচ বছর বয়সের নিচে শিশুদের সংখ্যা রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় জানাতে পারেনি। তবে এ সংখ্যা চার কোটির কাছাকাছি হবে বলে জানিয়েছেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ জামিলা আক্তার।
শিশুর জন্মনিবন্ধনে সবচেয়ে পিছিয়ে খুলনা বিভাগ। বিভাগটিতে পাঁচ বছরের নিচে শিশুর জন্মনিবন্ধনের হার ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ। সবচেয়ে এগিয়ে থাকা সিলেট বিভাগে নিবন্ধনের হার ৭২ দশমিক ৩ শতাংশ। বরিশালে ৬২ দশমিক ২, চট্টগ্রামে ৬৩ দশমিক ১, ঢাকায় ৫২ দশমিক ৩, ময়মনসিংহে ৫০ দশমিক ১, রাজশাহীতে ৫০ দশমিক ৬, রংপুরে ৫৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এদিকে শহরাঞ্চলের চেয়ে জন্মনিবন্ধনে দেশের গ্রামাঞ্চল কিছুটা এগিয়ে রয়েছে। শহরাঞ্চলে জন্মনিবন্ধনের হার ৫৩ দশমিক ৮ ও গ্রামাঞ্চলে ৫৬ দশমিক ৬ শতাংশ।
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা ২০১৮ অনুযায়ী, জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধনের কথা বলা হয়েছে। এ সময়ে মধ্যে বিনা মূল্যে করা গেলেও পরে বিভিন্ন পর্যায়ে নামমাত্র ফি নিয়ে জন্মনিবন্ধন করে সরকার।
রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে ১২টি সিটি করপোরেশনের ১২৪টি আঞ্চলিক অফিস, ৩২৮টি পৌরসভা, ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ, ১৫টি ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড মিলিয়ে ৫ হাজার ৩০টি অফিস ও ৫৫টি দূতাবাসসহ মোট ৫ হাজার ৮৫টি নিবন্ধকের অফিসে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের কার্যক্রম চলছে। অফিসে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে এবং অনলাইনের মাধ্যমে এ নিবন্ধন করা যায়।
ইউনিসেফ বলছে, দেশে পাঁচ বছরের নিচে এক কোটির বেশি (অনুমিত) শিশুর জন্মনিবন্ধন না হওয়ায় জাতীয় নীতিমালার পরিকল্পনা সঠিকভাবে করতে পারছে না সরকার। সংস্থাটি বলছে, জন্মনিবন্ধন সেবাটির বিষয়ে নারী ও মূলত কিশোরী মায়েরা তেমন অবগত নন। সাধারণত ছয় বছর বয়সে সন্তানকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করার সময় অভিভাবকরা শিশুর জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করে থাকেন। সরকারি অফিসে আসার খরচ ও হয়রানির কারণে তাদের মধ্যে এ সেবা গ্রহণে আগ্রহ দেখা যায় না।
জামিলা আক্তার জানান, জন্মনিবন্ধনের গুরুত্ব অভিভাবকরা এখনো বুঝতে পারছেন না। জন্মনিবন্ধনের জন্য সরকার প্রশিক্ষিত লোকবল নিয়োগ দিলে সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে। ৪৫ দিনের পর জন্মনিবন্ধন করাতে হলে সরকারি নির্ধারিত কিছু ফি দিতে হয়। তবে অনেক সময় এ ফি বেশি নেয়া হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে জন্মনিবন্ধন আইনের কিছু সংশোধন প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিন্তু জন্মনিবন্ধনের বিষয়টি হাসপাতালই করে থাকে। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নিবন্ধন হলে কোনো শিশুই জন্মনিবন্ধনের বাইরে থাকত না।
উপ-রেজিস্ট্রার জেনারেল একেএম মাকসুদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, শিশুর অভিভাবকরা জন্মনিবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। তাই বলে যখন দরকার হয় তখনই কেবল শিশুর জন্মনিবন্ধন করেন। এটা যে সচেতনতার অভাব তা বলা যাচ্ছে না। প্রয়োজনটাই বড়।