রাজধানীর শান্তিনগর থেকে গুলশানের দূরত্ব মোটে আট কিলোমিটার। এটুকু পথের জন্যই সাড়ে ৫ হাজার টাকা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া পরিশোধ করতে হয়েছে এক ব্যাংক কর্মকর্তাকে। গত মাসে অসুস্থ স্ত্রীকে গুলশানের বেসরকারি একটি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান তিনি। রোগী নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাসপাতালটির নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্সে করেই। অসুস্থ রোগী নিয়ে অনেকটা বিপদে পড়েই এ পরিমাণ অযৌক্তিক ভাড়া পরিশোধে বাধ্য হয়েছেন ওই ব্যাংক কর্মকর্তা।
এভাবেই বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে রোগী পরিবহন করতে গিয়ে বিপদগ্রস্ত অবস্থায় অনেকটা জিম্মি হয়েই অন্যায্য ও অযৌক্তিক পরিমাণে ভাড়া পরিশোধে বাধ্য হচ্ছেন জরুরি সেবাপ্রত্যাশীরা। সবচেয়ে বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে মরদেহ পরিবহনের ক্ষেত্রে। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালে কোনো রোগীর মৃত্যু হলে স্বজনদের মানসিক বিপর্যস্ততার সুযোগ নিয়ে আরো বেশি ভাড়া আদায় করে থাকেন চালকরা।
প্রায় সব ক্ষেত্রেই এ ভাড়ার পরিমাণ নির্ধারণ হচ্ছে মালিক বা চালকদের সঙ্গে মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, নীতিমালার না থাকার কারণেই সেবাপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে যথেচ্ছ পরিমাণে ভাড়া আদায় করে নিতে পারছেন বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের মালিক-চালকরা। এক্ষেত্রে সমস্যা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সেবার অপ্রতুলতা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অতীতে বেসরকারি উদ্যোগে চলাচলকারী অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) মধ্যেকার সমন্বয়হীনতার কারণে সেসব উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছে। ফলে চালক ও মালিকরা অনেকটা সিন্ডিকেট করেই অবাধে রোগী ও তাদের স্বজনদের কাছ থেকে লাগামহীন ভাড়া আদায় করে নিতে পারছে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, একটি বাহন অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে কী কী শর্ত পূরণ করবে তার সঠিক নির্দেশনাই যেখানে নেই, সেখানে ভাড়ার নীতিমালা হবে কীভাবে। অ্যাম্বুলেন্স সঠিকভাবে চালানো হচ্ছে কিনা, নিবন্ধনের পর সব ঠিক আছে কিনা তা দেখভাল করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু আমাদের এখান থেকে এমন কোনো তদারকি নেই।
শুধু নীতিমালা নয়, এ মুহূর্তে কতগুলো বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স চলাচল করছে, বিআরটিএ বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে তারও কোনো সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই। তবে বিআরটিএর অ্যাম্বুলেন্সের নিবন্ধন গ্রহণের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত অ্যাম্বুলেন্স ছিল ২ হাজার ৭৯৩টি। এর পর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত নিবন্ধন নিয়েছে আরো ৩ হাজার ৮৭৬টি। এর সবগুলোকেই সচল ধরে নিলে দেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা ৬ হাজার ৬৬৯টি। এর মধ্যে ৪ হাজার ৫০০টি আবার শুধু রাজধানী ঢাকার।
অন্যদিকে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়ার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও তা সংখ্যায় অপ্রতুল। এছাড়া বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের মালিক-চালকদের সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স পাওয়াটাও অনেক কঠিন। রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে দেখা গিয়েছে, এসব হাসপাতালের রোগী পরিবহনে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবহার তেমন একটা হচ্ছে না, যা চোখে পড়েছে তার বেশির ভাগই বেসরকারি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চালক জানান, দীর্ঘদিন ধরে অ্যাম্বুলেন্স চালিয়েছেন তিনি। এক হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার সঙ্গে আরেক হাসপাতালের মিল নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি ও বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের হিসাব ও দেখভালের বিষয়টির দায়িত্ব মূলত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। যদিও এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখায় যোগাযোগ করে দেশে সচল সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মোট অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা জানা যায়নি। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিটি বেজড হেলথ কেয়ারের (সিবিএইচসি) লাইন ডিরেক্টর ডা. সহদেব চন্দ্র রাজবংশী জানিয়েছেন, সারা দেশে বর্তমানে উপজেলাভিত্তিক সরকারি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে ৪৮৮টি। এর মধ্যে সচল রয়েছে ৪০২টি।
অন্যদিকে ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. লিটন খান জানান, ঢাকায় বর্তমানে সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স চলাচল করছে। ঢাকার বাইরে সারা দেশে রয়েছে প্রায় তিন হাজার। সব মিলিয়ে দেশে সাড়ে আট হাজারের বেশি সংখ্যক বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স রোগীদের জরুরি সেবা দিচ্ছে। এর মধ্যে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের প্রায় দুই হাজার অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এসব অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া নিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় প্রয়োজন বুঝে ভাড়া হাঁকেন মালিকরা। একেক প্রতিষ্ঠান একেক ধরনের ভাড়া নেয়। অ্যাম্বুলেন্স মালিকদের সংগঠনের বাইরে হাসপাতালভিত্তিক অ্যাম্বুলেন্স সংক্রান্ত আলাদা সংগঠনও রয়েছে।
রাজধানীতে প্রায় ৩০ বছর ধরে অ্যাম্বুলেন্স সেবা দিয়ে আসছে আলিফ অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস। এর স্বত্বাধিকারী মো. মমিন আলীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশে সাধারণ, আইসিইউ ও মরদেহ পরিবহনকারী মিলিয়ে তিন ধরনের অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। তেমনি ভাড়ায়ও ভিন্নতা রয়েছে। একটি অ্যাম্বুলেন্স ঢাকা মহানগরীর মধ্যে দিনে তিন-চারটি ট্রিপ দিতে পারে। তবে কোনো কোনো দিন একটিও মেলে না।
অন্য একটি অ্যাম্বুলেন্স সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান এম অ্যাম্বুলেন্সের স্বত্বাধিকারী আবু হানিফ জানান, রাজধানীর ভেতরে অ্যাম্বুলেন্সে রোগী পরিবহনে সর্বনিম্ন ২ হাজার টাকা ভাড়া পড়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাড়া ৫ হাজার টাকাও হতে পারে। ভাড়া নির্ধারণ হয় সাধারণত এসি, নন এসি ও গাড়ি ছোট-বড় হওয়ার ওপর ভিত্তি করে। নন এসি গাড়ির ভাড়া তুলনামূলক কম। এসি গাড়ির ভাড়া একটু বেশি নেয়া হয়। এছাড়া সড়কে খরচের ওপরেও ভাড়া নির্ভর করে।
ঢাকা থেকে দেশের অন্যান্য জেলায় গেলে দূরত্ব ও অন্যান্য খরচ হিসাব করে ভাড়া বলা হয়। ঢাকার বাইরেও ভাড়ার কোনো নিয়ম না থাকায় সেটিও নির্ধারণ করা হয় দরকষাকষির মাধ্যমে।
নীতিমালা না থাকায় অ্যাম্বুলেন্স মালিকদেরও যথাযথভাবে করজালের আওতায় আনতে পারছে না সরকার। অ্যাম্বুলেন্স মালিকদের কথা অনুযায়ী, তাদের একেকটি অ্যাম্বুলেন্স দিনে গড়ে ৩ হাজার টাকা করে আয় করলে বার্ষিক আয় দাঁড়ায় প্রায় ১১ লাখ টাকায়। সে হিসেবে বছরে সাড়ে ৮ হাজার অ্যাম্বুলেন্সের (বেসরকারি মালিকদের তথ্য অনুযায়ী) মোট আয় দাঁড়ায় সোয়া ৯০০ কোটি টাকারও বেশি। এ ভাড়া আদায়ের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতাকে কদাচিৎ কাগজে লিখিত বিল সরবরাহ করে থাকেন অ্যাম্বুলেন্স মালিকরা। ফলে সঠিক হিসাব না থাকার কারণে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স মালিকরাও আয়কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে সরকার বছরে মোটা অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতির অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বণিক বার্তাকে বলেন, অ্যাম্বুলেন্সগুলো বার্ষিক যে পরিমাণ টাকা আয় করছে, তার পুরোটাই যাচ্ছে ব্যবহারকারীর বাড়তি খরচ হিসেবে। কারণ এ টাকা সরকার বা অন্য কোনো সংস্থা দিচ্ছে না। এক্ষেত্রে দুটি নীতিমালা দরকার। একটি হলো কোন কোন শর্ত পূরণ হলে একটি যানকে অ্যাম্বুলেন্স বলা হবে, সে প্রসঙ্গে। অন্যটি হলো বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া নির্ধারণ সংক্রান্ত।
এদিকে একক ব্যক্তিগত মালিকানায় অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার বিষয়টি পুরোপুরি বেআইনি বলে জানিয়েছে বিআরটিএ। সংস্থাটি জানায়, লক্কড়ঝক্কড় অ্যাম্বুলেন্স ও অন্য যানকে অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তর করে কেউ কেউ এ ব্যবসা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। এ ধরনের অ্যাম্বুলেন্স রোগীর জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ বিষয়ে বিআরটিএ সদর দপ্তরের পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব ই রব্বানী বলেন, একক ব্যক্তির মালিকানাধীন অ্যাম্বুলেন্স বৈধ নয়। এগুলোকে কোনো প্রতিষ্ঠানের অধীনে চলাচল করতে হবে।