টানা কয়েকদিন অসুস্থ থাকার পর স্থানীয় সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন ফারুক হোসেন। রাজশাহীর পবা উপজেলার ওই হাসপাতালের চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে সাতদিনের ওষুধের কোর্স দেন। হাসপাতালের ফার্মেসি থেকে তাকে তিনদিনের ওষুধ দেয়া হয়। পেশায় দিনমজুর ফারুক আর্থিক সংকটের কারণে হাসপাতাল থেকে পাওয়া ওষুধ শেষ হলে আর কেনেননি। এমনকি ওষুধের সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করতে হবে এমন জোর পরামর্শও তিনি চিকিৎসকের কাছ থেকে পাননি।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, শুধু একজন ফারুক হোসেনই নন, যথানিয়মে অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স শেষ করে না দেশের ৪১ শতাংশ রোগী। অথচ অ্যান্টিবায়োটিকের অপপ্রয়োগ করা হলে বা কোর্স শেষ না করলে দেহে সংক্রমণ ঘটানো জীবাণু আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে ওই জীবাণুর ওপর অ্যান্টিবায়োটিকটি কাজ করে না। জীবাণুর মধ্যে এ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষমতা তৈরি হওয়ার সমস্যাটিকে চিকিৎসাবিজ্ঞান আখ্যা দিয়েছে ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স’ নামে।
বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা খাতে অনেক বড় এক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, এটি এখন বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য খাতে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর অন্যতম হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি এর প্রভাব পড়ছে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নেও। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ফলে যে কেউ যেকোনো বয়সে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। মূলত মানব ও প্রাণীদেহে অ্যান্টিবায়োটিকের অপপ্রয়োগের কারণে বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের প্রকোপ দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এর ফলে গোটা চিকিৎসা শাস্ত্রকেই এখন মারাত্মক এ হুমকির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সকে দেখা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ হিসেবে।
মূলত সরকারি হাসপাতালে ওষুধের সরবরাহ ঘাটতি, অসচেতনতা এবং সর্বোপরি চিকিৎসকের পরামর্শের অভাবের কারণে দেশে রোগীরা নিয়ম মেনে অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স শেষ করছে না। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণাটিতেও এ কথাই বলা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট ‘পেশেন্ট অ্যাওয়ারনেস অন দ্য র্যাশনাল ইউজ অ্যান্টিবায়োটিক অ্যান্ড ইটস রেজিস্ট্যান্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ গবেষণাটি পরিচালিত করছে।
গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলে বলা হয়েছে, রোগীরা ওষুধের কোর্স শেষ না করায় বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করায় সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। সরকারি হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিকের অপর্যাপ্ততা থাকলেও ফার্মেসিগুলো অনিয়মতান্ত্রিকভাবে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করে। দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য অনেক রোগীও অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণে আগ্রহ দেখায়। বেশির ভাগ ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের নির্দিষ্ট ডোজের কথা উল্লেখ থাকে না। ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক আছে কিনা, সে বিষয়টিও অনেক রোগী খতিয়ে দেখে না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানবদেহ, গবাদিপশু, পোলট্রি, মত্স্যপালন ও কৃষিতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের বিষয়ে সচেতনতা ও জ্ঞানের অভাব রয়েছে। ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক লেখায় এবং তা সরবরাহে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে মানুষের শরীর ও পরিবেশের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও হেলথ অ্যান্ড হোপ হসপিটালের পরিচালক ডা. লেলিন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার শুধু আমাদের দেশে নয়, এটি এখন বিশ্বব্যাপী সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিকের স্বল্প ব্যবহার, বেশি ব্যবহার ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার—সবই ক্ষতিকর। অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় জড়িত। আর তা হলো রোগী, চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্টের দায়িত্ব। এর কোনোটি ভেঙে পড়লে অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে না।’
গবেষণাটি করতে তথ্য নেয়া হয়েছে দেশের চার বিভাগের (ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রাম) চারটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চারটি জেলা হাসপাতাল, আটটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, আটটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, আটটি কমিউনিটি ক্লিনিক, চারটি বেসরকারি হাসপাতাল ও ১২টি ফার্মেসিতে আসা ৪৮০ জন সেবাপ্রত্যাশী থেকে। গুণগত ও পরিসংখ্যানগত বৈশিষ্ট্যের গবেষণাটিতে পর্যবেক্ষণ, গভীর সাক্ষাত্কার, মূল তথ্যদাতার সাক্ষাত্কার নেয়ার মতো গবেষণা পদ্ধতি প্রয়োগ করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে নীতিনির্ধারক, স্বাস্থ্য পেশাজীবী, চিকিৎসক, ওষুধ বিক্রেতা, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, ফার্মাসিস্ট, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, ঔষধ প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং কৃষি, পশু ও মত্স্য বিভাগের কর্মকর্তাসহ ১০৫ জনের সাক্ষাত্কার নেয়া হয়। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। গবেষণাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনের কাজ চলছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
গবেষণায় বলা হয়, অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে মানুষের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিকবিরোধী প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। শুধু সর্দি বা কাশি নিরাময়ের জন্য ৭৮ শতাংশ রোগী অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করে। চিকিৎসা পেশাজীবীদের এক-তৃতীয়াংশ রোগীদের উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের পরামর্শ দেন। অন্যদিকে ৬৩ শতাংশ রোগী তাদের অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শ দিতে অনুরোধ করে।
তথ্য সংগ্রহের শেষ তিন মাসে ৩৮ শতাংশ পুরুষ ও ৫৭ শতাংশ নারী অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করেছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। পূর্ণ কোর্স শেষ না করে এক থেকে তিনদিনের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ছেড়েছে ৬২ শতাংশ, পাঁচদিন পর ছেড়েছে ১৪ শতাংশ, ৩ শতাংশ ছেড়েছে সাতদিন পর, ১ শতাংশ ছেড়েছে ১০ দিনে। মাত্র ১ শতাংশ রোগী ১০ দিনের পরও অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ অব্যাহত রখেছে।
উদ্বেগজনক উল্লেখ করে গবেষণাটি বলছে, ৪৯ শতাংশ হাসপাতাল ও ক্লিনিক রোগীদের পূর্ণ কোর্সের অ্যান্টিবায়োটিক সরবরাহে অক্ষম। তারা মাত্র ৩৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে পূর্ণ কোর্সের অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারে। এর মধ্যে ৫১ শতাংশ ফার্মেসি, হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিক বলছে, রোগীদের প্রয়োজন অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিকের সরবরাহ অপ্রতুল।
কুমিল্লা সদর হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিকের স্বল্পতা রয়েছে। কিন্তু রোগীদের খুশি করতে আমাদের সবাইকেই তা দিতে হয়। অন্যথায় তারা নানা সমস্যা সৃষ্টি করে। তাই পূর্ণ কোর্স দেয়া যায় না। অ্যান্টিবায়োটিকের বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা না থাকায় এর অনিয়ন্ত্রিত প্রয়োগ হচ্ছে। অনেক চিকিৎসক জনপ্রিয়তা পেতে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শ দেন, এমনটি বলছিলেন রাজধানীর এক বেসরকারি চিকিৎসক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে প্রতি বছর সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রায় পাঁচ কোটি রোগী বহির্বিভাগের সেবা নেয়। এর মধ্যে সবাইকেই কম-বেশি ওষুধ দেয়া হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের রোগভেদে কিছু হাসপাতালে কোনো ওষুধ বেশি আবার কোনো হাসপাতালে ওষুধ কম হয়। এর মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের সংখ্যাও এলাকাভেদে বিভিন্ন ধরনের হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ওষুধের যে বাজেট থাকে, তাতে সবাইকে ওষুধ দেয়া যায় না। সাধারণত তিনদিনের ওষুধ দেয়া হয়। এরপর রোগীকে আবার আসতে বলা হয়। অনেক সময় দেখা যায় কোনো রোগীকে পূর্ণ কোর্সের ওষুধ দেয়া হলে তিনি একটু ভালো বোধ করার পর তা আর খান না। চিকিৎসকের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টির জন্য রোগীর সচেতনতাও জরুরি।’
গবেষণা দলের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. আব্দুল হামিদ বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে ওষুধের পর্যাপ্ততার অভাব রয়েছে। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। যে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন, তার দায়িত্ব হলো কতদিনের ওষুধ হাসপাতাল দিচ্ছে আর কতদিনেরটা নিজের কিনে নিতে হবে তা রোগীকে পরিষ্কারভাবে বলতে হবে। ক্ষতির দিকগুলোও বলতে হবে। অন্যথায় হাসপাতালের দেয়া ওষুধের বাইরে বাকিটা অনেকেই কেনে না। সেক্ষেত্রে টাকা বাঁচাতে গিয়ে আরো বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়ছে রোগীরা।’
মানুষের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার এবং বিষয়টি জানার জন্য এ গবেষণা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহাদাৎ হোসেন মাহমুদ।