যক্ষ্মা রোগীর ৮৫ শতাংশই মফস্বলের

মাদারীপুরের কিশোর সাব্বির আহমেদ। দীর্ঘদিন এক যক্ষ্মা রোগীর সংস্পর্শে থাকায় ২০১৫ সালে সংক্রামক এ রোগে আক্রান্ত হন তিনি। যক্ষ্মা শনাক্ত হওয়ায় রাজধানীর মালিবাগের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিন মাস চিকিৎসা করেও উন্নতি হয়নি তার। পরে বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ছয় মাস চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফেরেন। বাড়িতেই চিকিৎসা চলেছে। এখনো যক্ষ্মার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি।

যথাসময়ে শনাক্ত হওয়ায় যক্ষ্মার চিকিৎসা পেয়েছিলেন সাব্বির। তার মতোই দেশে শনাক্ত হওয়া যক্ষ্মা রোগীর ৮৫ শতাংশই মফস্বলের বাসিন্দা। তবে বাংলাদেশে অনেক যক্ষ্মা রোগী প্রতি বছর শনাক্তের বাইরে থেকে যান। এতে নির্বিঘ্নে বাড়ছে প্রাণঘাতী রোগটি। চিকিৎসায় যক্ষ্মা রোগীরা শতভাগ সুস্থ হন। এর পরও বছরে প্রায় ৪০ হাজার যক্ষ্মা রোগী মারা যান বলে জানিয়েছে সরকার। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ‘বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০’-এ তথ্য পাওয়া গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খোলা জায়গা কমে যাওয়া, পরিবেশ দূষণ, ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, মাদকাসক্তি, বার্ধক্য, অপুষ্টি যক্ষ্মার ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এমন (এইডস রোগী, দীর্ঘমেয়াদে স্টেরয়েড বা ইমিউনোথেরাপি) ওষুধসেবীরাও যক্ষ্মার ঝুঁকিতে রয়েছেন। একই সঙ্গে রোগ নির্ণয়ের বিষয়টিও জটিল হচ্ছে। অসচেতনতার কারণে মানুষ দেরিতে পরীক্ষা করছে। ফলে বেশ গোপনেই যক্ষ্মা বিস্তার লাভ করছে।

বার্ষিক ওই প্রতিবেদন বলেছে, সর্বশেষ ২০১৯ সালে শনাক্ত হওয়া যক্ষ্মা রোগীদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ উপজেলা পর্যায়ের বাসিন্দা। বাকি ১৩ শতাংশ মেট্রোপলিটন শহর এবং ১ শতাংশ বক্ষব্যাধি হাসপাতালের। প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ২২১ জন যক্ষ্মা রোগী রয়েছেন এমনটি অনুমিত হলেও লাখে ১৭৯ জন শনাক্ত হয়েছেন। ওই বছর দেশে ২ লাখ ৯২ হাজার ৯৪০ জন শনাক্ত হলেও শনাক্তের বাইরে থেকে যাচ্ছেন ১৯ শতাংশ রোগী। দেশে প্রতিদিন ৮০৩ জন যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মারা যাচ্ছেন ১০৭ জনের বেশি।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে কাজ করা এক চিকিৎসক জানান, প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব, আধুনিক যন্ত্রপাতির স্বল্পতা এবং অর্থের ঘাটতির কারণে অনেক রোগী শনাক্ত হচ্ছেন না। পুষ্টিহীনতা, দূষণ এবং দারিদ্র্যের কারণে মফস্বলে যক্ষ্মারোগীর সংখ্যা বেশি হতে পারে। গ্রামের লাকড়ির চুলার বায়ুদূষণের (ইনডোর এয়ার পলিউশন) কারণেও যক্ষ্মা রোগী বাড়ছে। একই ঘরে অনেকে একসঙ্গে থাকার কারণে এর সংক্রমণ বাড়ছে।

সরকারের প্রতিবেদন বলেছে, থুতু ও কফ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত হওয়া (নিউ পিউমোনারি ব্যাকটোরিওলজিক্যাল) রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ১ লাখ ৬২ হাজার ১৯৪ জন গত বছর কফ পরীক্ষা করে যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এক্স-রের মাধ্যমে পরীক্ষা করে শনাক্ত হয়েছেন ৬২ হাজার ৩৮৬ জন। ফুসফুস ছাড়া শরীরের অন্য অঙ্গে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫৩ হাজার ২৭৫ জন। পুনরায় যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছেন ১৩ হাজার ৭৩৮ জন। মারাত্মক আকার ধারণের পর শনাক্ত হয়েছেন ৫৮৬ জন, চিকিৎসা শেষ হওয়ার আগেই ওষুধ সেবন বাদ দিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন ১৭২ জন এবং অন্যান্য কারণে ৫৮৯ জন। দেশে শনাক্ত হওয়া রোগীর মধ্যে ৫৭ শতাংশ পুরুষ ও ৪৩ শতাংশ নারী। বিভাগভিত্তিক যক্ষ্মা রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে ঢাকা বিভাগে ও সবচেয়ে কম ময়মনসিংহ বিভাগে।

উপজেলা বা মফস্বলে যক্ষ্মার রোগী বেশি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও হেলথ অ্যান্ড হোপ হসপিটালের পরিচালক ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। গ্রামের অবকাঠামোর কারণে মানুষ অসুস্থ হলে হাসপাতালে না এসে দোকান থেকে ওষুধ কিনে খায়। মূল বিষয় হলো সচেতনতার অভাব।

জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম বণিক বার্তাকে জানান, যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসায় উপজেলাভিত্তিক সুবিধা বেশি। বেশির ভাগ মানুষ গ্রামের বাসিন্দা বিধায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং যক্ষ্মা হাসপাতালে রেজিস্ট্রেশন বেশি হয়। কাঠামোগতভাবে গ্রামের চিকিৎসা ভালো। সরকারের পাশাপাশি এখানে এনজিও (বেসরকারি সংস্থা) যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। যক্ষ্মা সংক্রামক রোগ হলেও যক্ষ্মা রোগী ১৫ দিন নিয়মিত ওষুধ খেলে তা আর সংক্রমণ ছড়ায় না বলে জানান এ শীর্ষ কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, ‘আমাদের হিসাবের এ সংখ্যা পুরোটাই অনুমিত। যে ১৯ শতাংশ শনাক্তের বাইরে থেকে যায় তার মূল কারণ পাঁচ বছরের শিশু। পাঁচ বছরের শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্ত করা কঠিন। ২০৩০ সালের মধ্যে যক্ষ্মাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। এ সময় প্রতি লাখে ১০ জন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হবে এবং প্রতি লাখে পাঁচজনের বেশি মারা যাবে না।’

চিকিৎসকরা বলছেন, যক্ষ্মা জীবাণুঘটিত মারাত্মক সংক্রামক রোগ, যা মাইক্রো-ব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস নামক জীবাণু দিয়ে হাঁচি-কাশির মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটিয়ে থাকে। এক নাগাড়ে তিন সপ্তাহের বেশি কাশি, জ্বর ও বুকব্যথা এ রোগের প্রধান লক্ষণ। আক্রান্ত ব্যক্তি চিকিৎসা না নিলে তার মাধ্যমে আরো ১০ জন পর্যন্ত আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অঞ্চল বিবেচনায় বাংলাদেশ যক্ষ্মাপ্রবণ এলাকা। বিশ্বে মোট যক্ষ্মা রোগীর মধ্যে ৪৪ শতাংশই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, যক্ষ্মার জীবাণু শুধু ফুসফুসকে আক্রান্ত করে না। মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে, ত্বক, অন্ত্র, লিভার, কিডনি, হাড়সহ দেহের যেকোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এর সংক্রমণ হতে পারে।

Source: Bonik Barta

Share the Post: