জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: ঋণ নিয়ে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় মেটাতে হচ্ছে ৯৩% বাস্তুচ্যুত মানুষের

খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম (৪০)। পেশায় রিকশাচালক। নদীর তীরে বসতি হওয়ায় সিডর, আইলাসহ বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড়ে তার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক সময় নদীগর্ভেই বিলীন হয়েছে তার বসতভিটা। অন্যত্র গেলে সেখান থেকেও প্রকৃতির নির্মমতায় হারান সহায়-সম্বল। কয়েক দফায় বাসস্থান পরিবর্তন করতে হওয়ায় বিভিন্ন সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হন রফিকের পরিবারের সদস্যরা। আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন তিনি। তবে ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি পেতে এক পর্যায়ে শেষ সম্বল কৃষিজমিও বিক্রি করতে হয় তাকে।

একই এলাকার নৌকার মাঝি মাজেদ আলী (৪৫)। গত বছর বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হওয়া ও নদীভাঙনে ভিটেবাড়ি হারিয়েছেন। বৃদ্ধ মাসহ পরিবারের ছয় সদস্য নিয়ে টেনেটুনে সংসার চালাচ্ছেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম এ ব্যক্তি অজানা রোগে ভুগছেন। পরিবারের অন্য সদস্যদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কাছ থেকে চড়া সুদে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন।

শুধু রফিকুল ইসলাম ও মাজেদ আলীই নন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এক সময় অনেকেরই সচ্ছলতা থাকলেও সহায়-সম্বল হারিয়ে এখন তাদের বেশির ভাগই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। ফলে দুর্গম এলাকায় সরকারি স্বাস্থ্যসেবার দুষ্প্রাপ্যতার কারণে ব্যক্তি উদ্যোগে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ৯৩ শতাংশকে ঋণ নিতে হচ্ছে। এ ঋণের সংস্থান হচ্ছে আত্মীয়, প্রতিবেশী ও এনজিও থেকে। এতে তারা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ছেন। সম্প্রতি এক গবেষণায় গত ১০ বছরে বাস্তুচ্যুতদের স্বাস্থ্যসেবার ঋণের বিষয়টি উঠে এসেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা যাবে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। আয়ের উৎস না থাকায় চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে তারা ঋণগ্রস্ত হচ্ছেন। মূলত প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার দুষ্প্রাপ্যতা ও অপ্রতুলতাও এর অন্যতম কারণ। কর্মহীন হয়ে পড়া এসব মানুষ বাধ্য হয়ে বেসরকারিভাবে স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে আর্থিক সংকটে পড়ছেন।

গত বছরের নভেম্বরে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক জার্নাল হিলিয়নে প্রকাশিত ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ ইমপ্যাক্টস অ্যান্ড অ্যাডাপ্টেশনস অন হেলথ অব ইন্টারনালি ডিসপ্লেজড পিপল (আইডিপি): অ্যান এক্সপ্লোরেটরি স্টাডি অন কোস্টাল এরিয়াস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধে বিষয়টি উঠে এসেছে। উপকূলীয় অঞ্চল খুলনার কয়রা ও বটিয়াঘাটা উপজেলার ৪২০টি বাস্তুচ্যুত পরিবারের ওপর গবেষণাটি করা হয়েছে। আট মাসব্যাপী মাঠকর্মে গুণগত ও পরিসংখ্যানগত গবেষণার বেশ কয়েকটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

গবেষণায় বলা হয়, গত ১০ বছরে নদীভাঙনের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ, জীবনযাত্রার মান হারিয়ে ১৯ শতাংশ, কৃষি ব্যবস্থা ধ্বংসের কারণে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং বিশুদ্ধ পানির অভাবে ২ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। স্থানান্তরিত হওয়ার পরও নতুন পরিবেশে বিরূপ পরিস্থিতির মুখে পড়েছে ৭৮ শতাংশ পরিবার। নতুন জায়গায় গরমে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, শীতের তাপমাত্রার পরিবর্তন, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। পুরনো স্থানের চেয়ে নতুন পরিবেশে গিয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি মানুষ রোগাক্রান্ত হচ্ছেন। মূলত পানিবাহিত এবং রক্তচোষা কীটবাহিত বিভিন্ন সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ আগের তুলনায় বেশি হচ্ছে। আগের পরিবেশে চর্মরোগে ৫২ শতাংশ মানুষ সংক্রমিত হলেও বর্তমান স্থানে ৭১ শতাংশের মধ্যে এ রোগ দেখা যাচ্ছে। ঠিক এমনই ডায়রিয়া, কলেরা, জন্ডিস, পাতলা পায়খানা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের হার বেড়েছে।

উপকূলীয় এ বাস্তুচ্যুতরা চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন। অর্থের স্বল্পতার কারণে ৯৩ শতাংশ, স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য প্রাপ্তির সীমাবদ্ধতায় ৯১ শতাংশ, যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসকের অভাবে ৮৮ শতাংশ, দুর্বল সামাজিক ব্যবস্থার কারণে ৭৭ শতাংশ, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে ৩৩ শতাংশ, লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে ২৬ শতাংশ এবং ধর্মীয় চর্চার ভিন্নতার কারণে ১৭ শতাংশ মানুষ স্বাভাবিক সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন।

গবেষণাটির চার গবেষকের একজন হলেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক মো. আরিফ চৌধুরী। তিনি বণিক বার্তাকে জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে বাস্তুচ্যুত হওয়া পরিবারগুলো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। একই সঙ্গে বাস্তুচ্যুত হয়ে তারা একক পরিবারে পরিণত হয়। আপত্কাল মোকাবেলার জন্য তাদের সঞ্চয় করার মতো উপার্জন নেই। কাছাকাছি সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান বলতে ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা তারা পান না। এসব কারণে তারা ঋণ নিয়ে মফস্বল বা জেলা বা বিভাগীয় শহরে এসে চিকিৎসকের ফি দেন, রোগী নিরীক্ষণ এবং ওষুধ ক্রয়ে খরচ করেন। অনেক সময় সচেতনতার কারণে তারা ওষুধ গ্রহণেও অবহেলা করেন। ফলে তাদের খরচ আরো বেড়ে যায়। উপকূলীয় অঞ্চলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় পল্লী ও হাতুড়ে চিকিৎসকের ওপরই তাদের নির্ভর করতে হয়।

আর্থিক সংকট থাকায় বেশির ভাগ বাস্তুচ্যুত আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক ঋণ নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করেন। তাদের মধ্যে ৯২ দশমিক ৯ শতাংশ আত্মীয়ের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চিকিৎসা এবং ওষুধে ব্যয় মেটান। ৮১ শতাংশ ঋণ করেন প্রতিবেশীর কাছ থেকে, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে ঋণ নিয়ে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করেন ২ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ। দরিদ্র এসব পরিবার সব হারিয়ে শেষ সম্বল গবাদিপশু এবং উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অল্প পরিমাণের অলঙ্কার আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইলেও তা হাতছাড়া করতে হয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গিয়ে। গবাদি পশু-পাখি বিক্রি করে স্বাস্থ্যসেবার খরচ মেটান ১৯ শতাংশ এবং অলংকার বিক্রি করেন ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ।

কয়রা উপজেলার আরেক বাস্তুচ্যুত হুমায়ুন কবির (৪৫)। কর্মহীন হওয়ার কারণে স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। বর্তমানে দিনমজুরের কাজ করা এ ব্যক্তি ঋণের বোঝা কমাতে স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কাছ থেকে আবারো অর্ধ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বাড়ি থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাতায়াতে খরচ হয় ১২০ টাকা পর্যন্ত। কাছাকাছি কোথাও কমিউনিটি ক্লিনিকও নেই। সরকারি ব্যবস্থাপনায় গ্রামে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা মিললেও বড় ধরনের সেবা পাওয়া যায় না। তা-ও সব দিন মেলে না, যা রোজগার করি তাতে খেয়েপরে বাঁচা কষ্টের। এর মধ্যে রোগ-শোক হলে ঋণ করতেই হয়।’

তবে স্বাস্থ্যসেবার জন্য ঋণের বিষয়টি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হচ্ছে এমন বিষয়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন বুয়েটের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং পানি ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, ‘সবকিছুকে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী করা ঠিক হবে না। এতে জলবায়ু পরিবর্তনের মূল চ্যালেঞ্জই বিলীন হয়ে যাবে। উপকূলীয় অঞ্চল সবচেয়ে ঝুঁকিতে এটা সত্য হলেও যেসব রোগের কথা বলা হচ্ছে, তা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। স্বাস্থ্যসেবা পেতে বাস্তুচ্যুতদের ঋণ নেয়ার বিষয়টি সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং দুর্নীতির কারণে হচ্ছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা সঠিক তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি।’

বাস্তুচ্যুত এসব মানুষের দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের ভেতর থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দরিদ্র এসব মানুষের সম্পদ বলতে কায়িক শ্রম এবং গবাদি পশু-পাখি। তাদের এসব বিক্রি ও ঋণ করে স্বাস্থ্যসেবার জন্য খরচ করতে হয়। এর থেকে রাতারাতি বের হওয়া যাবে না। তবে সরকারের যে কাঠামো রয়েছে, তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করা গেলে উপকূলের মানুষের মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ভালো কাঠামো রয়েছে কিন্তু প্রায়োগিক ব্যবস্থা খুবই দুর্বল।’

সরকারি স্বাস্থ্যসেবার বাইরেও মানুষের বাড়তি খরচ হয় মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শুধু সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সব সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সমাজসেবা কার্যক্রম থেকে শুরু করে স্থানীয় সচেতনতা খুবই জরুরি। সরকার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য কোনো অংশেই ত্রুটি রাখছে না। এসব উপজেলায় আমি কথা বলে ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করব।’

Source: Bonik Barta

Share the Post: