পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি: বেসরকারি হাসপাতালেও জায়গা হচ্ছে না সংকটাপন্ন রোগীদের

চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতির দ্রুত অবনতিতে বিপর্যস্ত দেশ। পাঁচ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে দেশে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। প্রায় প্রতিদিনই সংক্রমণের নতুন রেকর্ড হচ্ছে। এর মধ্যে এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন গড়ে অর্ধশতাধিক কভিড-১৯ পজিটিভ রোগী মারা যাচ্ছেন। সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য রাজধানীর সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে। সংকটাপন্ন রোগীদের অনেকেই এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তি হতে পারছেন না। একাধিক হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে গিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে মৃত্যুর সংবাদও পাওয়া যাচ্ছে। একই সঙ্গে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরের বেসরকারি হাসপাতালগুলোও সংকটাপন্ন কভিড-১৯ রোগীদের জায়গা দিতে পারছে না। এসব হাসপাতালে কভিড রোগীদের সাধারণ শয্যাসহ নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রও (আইসিইউ) প্রায় পূর্ণ। এ অবস্থায় রোগী ও তাদের স্বজনসহ মানুষের মাঝে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া নিয়ে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে না পারলে শয্যা বৃদ্ধি করেও লাভ হবে না। চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধেই গুরুত্ব বেশি দিতে হবে। এক বছরের অভিজ্ঞতা থাকার পরও দ্বিতীয় ধাপের ধাক্কা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দেরি হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, রাজধানীর নয়টি কভিড বেসরকারি হাসপাতালের সাধারণ শয্যার ৬২ শতাংশে রোগী ভর্তি রয়েছেন। একই সঙ্গে আইসিইউ শয্যার ৭৮ শতাংশে ভর্তি রয়েছেন সংকটাপন্ন রোগী। তবে বেশির ভাগ হাসপাতালের সাধারণ ও আইসিইউ শয্যার একটিও খালি নেই। এসব হাসপাতালের মধ্যে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটালে ৬২ শয্যার মধ্যে ৫৯টি, এএমজেড হাসপাতালে ৯০টি শয্যার মধ্যে ৮৩টি, এভার কেয়ার হাসপাতালে ২৮টির মধ্যে ২৭টি, স্কয়ার হাসপাতালের ৬৫টির মধ্যে ৫৫টি, ইউনাইটেড হাসপাতালের ৮০টির মধ্যে ৬৮টি এবং ইবনে সিনা হাসপাতালে ৪৪টির সবক’টি শয্যায় রোগী ভর্তি রয়েছেন।

অন্যদিকে স্কয়ার হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের ১৯টি শয্যার মধ্যে ১৭টি, এভার কেয়ার হাসপাতালে ২১টির মধ্যে ২০টি, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটালে নয়টির মধ্যে সাতটিতে রোগী ভর্তি রয়েছেন। ইবনে সিনা হাসপাতালের পাঁচটি, ইমপালস হাসপাতালের ৪০টি এবং এএমজেড হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ শয্যার সবক’টিতে রোগী ভর্তি রয়েছেন।

বেসরকারি হাসপাতালের করোনা রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যা এবং আইসিইউ শয্যা কিছুটা খালি থাকার কথা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দাবি করলেও এসব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিদিনই রোগী ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। যারা ভর্তি হচ্ছেন তাদের সবাই সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছেন।

এভার কেয়ার হাসপাতালের উপব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কাইয়ুম খান রাজু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তিন-চারদিন ধরে আমরা নতুন কভিড-১৯ রোগী ভর্তি করতে পারছি না। ভর্তির জন্য আগতদের প্রতিদিনই ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। যারা এখন ভর্তি রয়েছেন, তাদের সবারই অবস্থা সংকটাপন্ন। আইসিইউর একটি শয্যাও খালি নেই। রোগী ভর্তির জন্য অনুরোধ এলেও আমরা ভর্তি করতে পারছি না।’

রাজধানীর বাইরে দেশের অন্য বড় শহরগুলোর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও রোগীর ভিড় বেড়েছে। এতে শয্যা সংকুলান না হওয়ায় তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম মহানগরীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি করোনা হাসপাতাল চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের ১৬টি আইসিইউ শয্যার সবক’টি গতকাল পূর্ণ ছিল বলে জানা যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনতে না পারলে শয্যা বাড়িয়ে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসকে মোকাবেলা করা যাবে না। আক্রান্তদের মধ্যে মৃদু ও মধ্যম পর্যায়ের রোগীদের বাসায় থাকতে সরকারের পরামর্শ দেয়া উচিত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ফোনে যোগাযোগ করে তাদের চিকিৎসা দেয়া উচিত। যাদের অবস্থা সংকটাপন্ন তাদের জন্য হাসপাতালে ব্যবস্থা করা যেতে পারে। স্বল্প সময়ে ফিল্ড হাসপাতালের ব্যবস্থা করা জরুরি। যাতে রোগীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়া যায়। এতে হাসপাতালের ওপর চাপ কমবে এবং মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাবে। অক্সিজেনেরও যথাযথ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

স্বল্প সময়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সংক্রমণের হার কমানোর জন্য জনসচেতনতা আরো বাড়াতে হবে। অল্প সময়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন সামরিক, আধাসামরিক ও বেসামরিক বাহিনীকে প্রস্তুত করতে হবে। সরকার যে ১৮ দফার সিদ্ধান্ত দিয়েছিল, তা খুব দেরিতে হয়েছে। একই সঙ্গে যে লকডাউন দেয়া হচ্ছে তারও যথাযথ পরিকল্পনা নেই। গত বছরের সংক্রমণের শীর্ষের সময়ের অভিজ্ঞতা আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। আমাদের প্রস্তুতিরও ঘাটতি রয়েছে।’

সংক্রমণ আরো বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক ও সাবেক প্রধান বিজ্ঞানী ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বড় বড় শহরে ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করতে হবে। এমন স্থানে করতে হবে যেখানে মানুষ সহজেই সেবা নিতে পারেন। এতে অক্সিজেনের ব্যবস্থাও রাখতে হবে। এ হাসপাতাল প্রস্তুত করতে এক সপ্তাহ বা তার বেশি সময় লাগবে। এতে অল্প খরচে বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে। মানুষের জীবন বাঁচবে।

মানুষ আতঙ্কিত হবে না।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র এবং পরিচালক (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা নন-কভিড হাসপাতাল কমিয়ে কভিড হাসপাতাল বাড়াচ্ছি। ফিল্ড হাসপাতাল করারও চিন্তা করা হচ্ছে। রাজধানীর মহাখালীতে ডিএনসিসি মার্কেটে আইসোলেশন সেন্টার আর সপ্তাহ খানেক সময়ের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে যাবে। সেখানে দেড় হাজারের মতো শয্যা করা হচ্ছে। এছাড়া টেলিমেডিসিনের দিকে জোর দেয়া হচ্ছে।’

এদিকে গতকাল আরো ৫ হাজার ৬৮৩ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ সময় ৫৮ জন কভিড-১৯ পজিটিভ রোগী মারা গেছেন। তবে সপ্তাহের ব্যবধানে ৬৭ শতাংশ রোগী বাড়লেও আগের সপ্তাহের তুলনায় গত সপ্তাহে সরকারি ব্যবস্থাপনায় নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কমেছে। দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বিকালে এক স্বাস্থ্য সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

জানা যায়, গত ২১ থেকে ২৭ মার্চ সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১ লাখ ২২ হাজার ৬২টি নমুনা পরীক্ষাসহ মোট নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৬৮৩টি। এ সময় ২৩ হাজার ১০০ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। অন্যদিকে গত ২৮ মার্চ থেকে গতকাল পর্যন্ত সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১ লাখ ১৯ হাজার ২০০টি নমুনা পরীক্ষাসহ মোট নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৯৬৭টি। এ সময় ৩৮ হাজার ৪৭১ জন কভিড-১৯ সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। সপ্তাহের ব্যবধানে ১৫ হাজারের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হলেও সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষার সংখ্যা কমেছে। একই সঙ্গে সপ্তাহের ব্যবধানে মৃত্যু বেড়েছে ৭১ দশমিক ১৪ শতাংশ।

গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি ২২৭টি পরীক্ষাগারে ২৪ হাজার ৫৪৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত মোট সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৪৭ লাখ ৫২ হাজার ৬৬১টি নমুনা পরীক্ষা করা হলে ৬ লাখ ৩০ হাজার ২৭৭ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত কভিড-১৯ পজিটিভ রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ২১৩ জনে। মোট সুস্থ হয়েছেন ৫ লাখ ৪৯ হাজার ৭৭৫ জন।

Source: Bonik Barta

Share the Post: