গত বছরের মার্চে দেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম শনাক্ত হয়। এর এক বছরের মাথায় চলতি বছরের মার্চে দ্বিতীয় দফা সংক্রমণ দেখা দেয়। ওই মাসের শেষ থেকেই সংক্রমণের তীব্রতা বেড়ে চলেছে। সংক্রমণ শনাক্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সংকটাপন্ন রোগীর সংখ্যা। এসব রোগীর অধিকাংশের চিকিৎসায় প্রয়োজন পড়ছে বিশেষ ধরনের যন্ত্রপাতির। তবে চাহিদা বাড়লেও এসব চিকিৎসাযন্ত্রের জোগান সেভাবে বাড়েনি। ফলে করোনা রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহূত এসব যন্ত্রের সংকট তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য বলছে, চাহিদার তুলনায় সরকারের কাছে মজুদ রয়েছে মাত্র ৩৯ শতাংশ যন্ত্রপাতি।
সারা দেশে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বেশ কয়েক ধরনের যন্ত্রপাতির চাহিদাপত্র সম্প্রতি তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। চাহিদাপত্রটি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ঘুরে যাবে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে। এরপর ক্রয় প্রক্রিয়া শেষে এসব যন্ত্র সরবরাহ করা হবে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোতে। ক্রয় ও সরবরাহের পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে কমপক্ষে এক-দেড় মাস সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
চাহিদাপত্রে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরসহ আটটি বিভাগের জন্য পাঁচ ধরনের যন্ত্রসহ বেশকিছু উপকরণের কথা বলা হয়েছে। এতে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার চাহিদা দেয়া হয়েছে ৩ হাজার ৯১টি, অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ২ হাজার ২১৬টি, মনিটরসহ আইসিইউ বেড ৯৩৭টি, ভেন্টিলেটর ৭৩৬টি ও অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাহিদা দেয়া হয়েছে ২১ হাজার ২৭৯টি। সব মিলিয়ে মোট ২৮ হাজার ২৫৯টি যন্ত্রের চাহিদা দেয়া হয়েছে। তবে এর মধ্যে ১০ হাজার ৯৬৪টি যন্ত্র মজুদ আছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার। শতকরা হিসাবে যা ৩৯ শতাংশ।
চাহিদার তালিকায় আরো আছে ৬ লাখ ৩৩ হাজার ৬৫৯টি রেমডিসিভির ইনজেকশন, ১০ লাখ ৫৯ হাজার ৮১৪টি আরটি-পিসিআর টেস্ট কিট, ২০ লাখ ৩১ হাজার ৩৯৫টি পিপিই কাভারঅলসহ (ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী) ও ২৩ লাখ ২৩ হাজার ৮১৬টি মাস্ক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সংকটাপন্ন রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় হঠাৎ করেই জরুরি চিকিৎসা সেবার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির চাহিদা দেখা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই সব বিভাগীয় পরিচালককে (স্বাস্থ্য) এ-সংক্রান্ত চাহিদা জানাতে বলা হয়। তাদের পাঠানো চাহিদার তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি চাহিদাপত্র তৈরি করা হয়। গত ৩ এপ্রিল এ চাহিদাপত্র স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, শিগগিরই চিঠি আকারে চাহিদাপত্র মন্ত্রণালয়কে পাঠানো হবে। তিনি বলেন, বিভাগীয় পরিচালকদের কাছ থেকে পাওয়া চাহিদা অনুযায়ী তালিকা তৈরি করা হয়েছে। মন্ত্রীকে তালিকা দেয়া হয়েছে, তবে দ্রুত চিঠি তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। বেশির ভাগ যন্ত্রই কিনতে হবে বলে জানান তিনি।
কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) একটি সূত্র জানিয়েছে, গতকাল পর্যন্ত তাদের কাছে যে মজুদ আছে সে অনুযায়ী হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা আছে ৩৩০টি, অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ২ হাজার ২০০টি, আইসিইউ বেড ৩০৭টি, মনিটর ৭৩টি, ভেন্টিলেটর ১০৭টি ও অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে ৮-১০ হাজারটি।
মজুদ থেকে প্রতিদিনই বিভিন্ন হাসপাতালের চাহিদা অনুযায়ী যন্ত্র পাঠানো হচ্ছে বলে জানান সিএমএসডির উপপরিচালক ডা. তউহীদ আহমেদ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের কাছে যা মজুদ রয়েছে তা প্রতিদিনই চাহিদা অনুযায়ী সরকারি হাসপাতালগুলোকে বিতরণ করা হচ্ছে। আজ যে পরিমাণে আছে আগামীকাল সেই সংখ্যা নাও থাকতে পারে। এখন মন্ত্রণালয় চাহিদাপত্র দিলে সে অনুযায়ী যন্ত্র কেনা ও বিতরণ করা হবে।
চাহিদা আসার পর জরুরি প্রয়োজন বুঝে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী এসব যন্ত্রপাতি কেনা হয় জানিয়ে ডা. তউহীদ আহমেদ বলেন, উন্মুক্ত দরপত্রের (ওটিএম) মাধ্যমে কেনা হলে তাতে অনেক সময় লেগে যায়। তবে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) কেনা হলেও এসব যন্ত্রপাতি পেতে এক-দেড় মাসের মতো সময় লাগে। এ পদ্ধতিতে যেকোনো একটি প্রতিষ্ঠানকেই ক্রয়াদেশ দিতে হয়। এছাড়া বিভিন্নভাবে সরকারও যন্ত্রপাতি আমদানি করতে পারে।
এসব যন্ত্রের যে এত চাহিদা হবে তা আগে ধারণা করা যায়নি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা। তারা বলেন, কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই হঠাৎ করে বেড়ে গেছে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ। তাই মজুদ থাকা যন্ত্রপাতির ওপরও চাপ বেড়েছে।
জরুরি এসব যন্ত্রপাতির তালিকা তৈরি করতে দেরি হলেও কিনতে ও সরবরাহ করতে বেশি সময়ক্ষেপণ করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন করোনা বিষয়ে সরকারের গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, তালিকা করতে সময় লেগে গেছে। তাই এখন আর সময় নষ্ট করা উচিত হবে না। যত দ্রুত সম্ভব সরকারের উচিত এসব যন্ত্র কেনা ও সরবরাহ করা। শুধু পরিসংখ্যান বা বিশ্লেষণ করলে চলবে না।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বণিক বার্তাকে বলেন, কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে যে পরিমাণ যন্ত্রপাতি মজুদ রয়েছে তাতে সংকট মোকাবেলা করা যাবে। আশা করা যাচ্ছে যে এসব শেষ হওয়ার আগেই চাহিদা অনুযায়ী যন্ত্রপাতি কেনা হয়ে যাবে। তালিকা করতে একটু দেরি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এর কারণ হলো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এছাড়া সিএমএসডি তাদের মজুদ জানাতে সময় নিয়েছিল। এরপর চাহিদার তালিকা হাতে পাওয়ার পর তা যাচাই-বাছাইয়ে সময় লেগেছে। এখন যেহেতু তালিকা তৈরি হয়ে গেছে, শিগগিরই এটি পাঠিয়ে দেয়া হবে।