দেশে নভেল করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার অপর্যাপ্ততা দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই জটিল ও সংকটাপন্ন কভিড-১৯ পজিটিভ রোগীর ভিড় বাড়ছে হাসপাতালে। সংকট ও পরিস্থিতি মোকাবেলায় রাজধানীর তিন স্থানে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ তিন স্থানের মধ্যে রয়েছে আর্মি স্টেডিয়াম, তিতুমীর কলেজ ও ঢাকা কলেজ। প্রস্তাবিত এসব স্থানে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করা যাবে কিনা তা যাচাইয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সশস্ত্র বাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এদিকে গত বছরের মার্চে দেশে নভেল করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর গতকাল সর্বোচ্চ ৬৬ জনের মৃত্যু ও ৭ হাজার ২১৩ জন সংক্রমিত হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছর বন্ধ হওয়া সরকারি ও বেসরকারি করোনা হাসপাতাল চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে ঢাকাসহ দেশের জনবহুল শহরে ফিল্ড হাসপাতালেরও পরিকল্পনা করা হচ্ছে। রাজধানীতে তিনটি স্থানে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
গত শনিবার বিকালে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিভিন্ন অধিদপ্তর, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে উচ্চপর্যায়ের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশব্যাপী কয়েক দফা বিধিনিষেধের (লকডাউন) বিষয়ে আলোচনা হয়। এ সময় করোনা রোগীদের চিকিৎসায় ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের বিষয়ে আলোচনা হয়। এতে রাজধানীর তিন স্থানে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় সবচেয়ে বড় কার্যকর ভূমিকা রাখে ফিল্ড হাসপাতাল। করোনার ঊর্ধ্বমুখী পরিস্থিতি সে অবস্থার সৃষ্টি করেছে। কয়েক সপ্তাহ ধরেই হাসপাতালের ওপর চাপ বেড়েছে। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় নতুন রোগী ভর্তি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এমন অবস্থায় ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করা হলে মানুষ মৃদু লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে ভিড় করবে না। কারো মধ্যে করোনার লক্ষণ দেখা গেলে তিনি বাড়িতে আইসোলেশনে থাকতে চান না। ফিল্ড হাসপাতালে এসব রোগীকে পুরোপুরি আইসোলেশনে রাখা যাবে। ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে রাখা গেলে সংকটাপন্ন অবস্থা কাটানো সম্ভব হবে। এতে আগেই ব্যবস্থা নিলে তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা লাগে না। ফিল্ড হাসপাতালে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসা ও অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপন করা না গেলেও সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করতে হবে। রোগীর অবস্থা জটিল হলে তবেই হাসপাতালে হস্তান্তর করতে হবে। ফিল্ড হাসপাতালের সবচেয়ে বড় উপকারিতা হলো রোগের সংক্রমণ বিস্তার (কমিউনিটি ট্রান্সমিশন) প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, সভায় রাজধানীতে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফিল্ড হাসপাতালের জন্য আর্মি স্টেডিয়াম, ঢাকা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজকে ধরে প্রাথমিকভাবে আলোচনা হয়েছে। এসব স্থানে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করা যাবে কিনা তা যাচাইয়ের জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে বলা হয়েছে। তারা সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর এসব হাসপাতাল তৈরি করা হবে। হাসপাতালের চাহিদা অনুযায়ী রোগীদের সেবার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চিকিৎসক, নার্স, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও ওষুধ সরবরাহ করবে।
এদিকে গতকাল দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সর্বোচ্চসংখ্যক কভিড-১৯ পজিটিভ রোগীর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৬৬ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী মারা যাওয়ায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৩৮৪। এ সময়ে আরো ৭ হাজার ২১৩ জনের শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ায় দেশে মোট করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৫১ হাজার ৬৫২। গত বছরের মার্চে দেশে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর মৃত্যু ও সংক্রমণের সব রেকর্ড গতকাল ছাড়িয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি করোনা হাসপাতালে সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।
গতকাল রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি ১৯টি হাসপাতালে কভিড রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যার ৯২ শতাংশেই রোগী ভর্তি ছিল। এসব হাসপাতালে মোট আইসিইউ শয্যার ৯২ শতাংশ সংকটাপন্ন রোগীতে পূর্ণ ছিল। সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি আইসিইউ শয্যার ৭০ শতাংশ রোগীতে পূর্ণ ছিল। সংক্রমণের এমন চিত্রে শিগগিরই রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোতে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য ও ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করলে সেখানে রোগীরা তেমন একটা যায় না। গত বছর যেসব অস্থায়ী হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছিল, তাতে ভালো অভিজ্ঞতা হয়নি। মোটা অংকের অর্থ ব্যয় করে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করেও উপকার পাওয়া যায়নি।
গত বছর ফিল্ড হাসপাতাল কোনো কাজে আসেনি—এমনটি মনে করছেন না সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক ও সাবেক উপদেষ্টা ডা. মোশতাক হোসেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, গত বছর ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের পর রোগীর সংখ্যা কমে গিয়েছিল। বিষয়টি এমন নয় যে ঘূর্ণিঝড় আসবে বলে প্রস্তুতি নিয়ে ঝড় এল না বলে আক্ষেপ করব। সর্বোচ্চ খারাপ পরিস্থিতি ধরে নিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে এবং আশা করতে হবে যেন ভালো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তবেই কেবল ভালো কিছু হবে। ফিল্ড হাসপাতাল অবশ্যই জনবহুল এলাকায় করতে হবে। দূরে করলে মানুষ যেতে চাইবে না। ফলে হাসপাতালের ওপরই চাপ আসবে। গত বছর ফিল্ড হাসপাতালের পরিকল্পনায়ও ঘাটতি ছিল। সব সম্ভাব্যতা যাচাই করে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে।
গত রোববার দেশব্যাপী চলাচলে নিষেধাজ্ঞা বা সার্বিক কার্যাবলির নির্দেশনায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারীকৃত প্রজ্ঞাপনে ফিল্ড হাসপাতালের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, সশস্ত্র বাহিনী ঢাকার সুবিধাজনক স্থানে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনে সশস্ত্র বাহিনীর অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে উল্লেখ করে সরকার গঠিত করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, মিশনে বিভিন্ন দেশে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন ও চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাদের মেডিকেল কোর স্বয়ংসম্পূর্ণ। একই সঙ্গে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করলে রোগীরা ভালো সেবা পাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যা ৯ হাজার ৬৮৬টি, আইসিইউ শয্যা ৫৯৭, অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংখ্যা ১৪ হাজার ৫৭৩টি, হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ৯৯৮ এবং অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ৮৭৭টি। দেশে সব সরকারি হাসপাতালে (সেকেন্ডারি পর্যায়ে) কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সংযোগ স্থাপন করা যায়নি। সারা দেশে কভিড রোগীদের চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালে পাঁচ ধরনের যন্ত্রসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণের চাহিদা তালিকা সম্প্রতি তৈরি করা হয়েছে।
দেশে ফিল্ড হাসপাতালের অভিজ্ঞতা ভালো নয় বলে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ওই মিটিংয়ে ফিল্ড হাসপাতালের বিষয়ে কথা হয়েছে। তিনটি জায়গার কথা বলাও হয়েছে। ফিল্ড হাসপাতাল বাস্তবায়ন করবে সশস্ত্র বাহিনী। এর আগে গত বছর ফিল্ড হাসপাতাল তেমন একটা কাজে আসেনি। মানুষ চিকিৎসার জন্য যায়নি বলে খালি পড়ে ছিল। অনেক টাকা ভাড়া দিতে হয়েছে। এখনো কয়েক কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। তবে ফিল্ড হাসপাতালের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। উপযুক্ত স্থান নির্ধারণের চেষ্টা চলছে।