কভিডের বিস্তার প্রতিরোধের স্বীকৃত ও সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো কঠোরভাবে চলাচল নিয়ন্ত্রণ। চীন, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বেশকিছু দেশ এ পদ্ধতি অনুসরণ করে বেশ সাফল্য পেয়েছে। করোনা প্রাদুর্ভাবের পর এমন বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশও। যদিও বাস্তবায়নে শৈথিল্য ও জনসচেতনতার অভাবে সেগুলো ভেস্তে যায়। বেশির ভাগ সময়ই স্থল, সমুদ্র ও বিমানবন্দরসহ দেশের আন্তর্জাতিক প্রবেশমুখগুলো ছিল অনিয়ন্ত্রিত। শৈথিল্য ছিল অভ্যন্তরীণ চলাচল নিয়ন্ত্রণেও। জাতিসংঘের তথ্যও বলছে, প্রবেশমুখ ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণেই সংক্রমণের দ্বিতীয় প্রবাহেও বড় ঝুঁকিতে পড়ে যায় বাংলাদেশ।
মহামারীকালে বিভিন্ন দেশের বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের মাত্রা নিরূপণে একটি অনলাইন টুল ও ডাটাবেজ তৈরি করেছে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)। এজন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নৌ, স্থল ও বিমানবন্দরসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ট্রানজিট পয়েন্টের করোনাকালীন কার্যক্রম ও চলাচল নিয়ন্ত্রণের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সংস্থাটির ডিসপ্লেসমেন্ট ট্র্যাকিং ম্যাট্রিক্স (ডিটিএম) রিম্যাপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে আটটি বিমানবন্দর, ১২টি স্থলবন্দর ও তিনটি সমুদ্রবন্দর রয়েছে। করোনাকালের (গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) বেশির ভাগ সময়ই এসব প্রবেশমুখ ছিল উন্মুক্ত। এর মধ্যে পুরোপুরি সচল ছিল ১০টি। আংশিকভাবে সচল ছিল নয়টি। এছাড়া তিনটি বন্দর পুরোপুরি বন্ধ ছিল।
প্রতিবেদনে দেশের প্রবেশমুখগুলোর মহামারীকালীন কার্যক্রমের মাসভিত্তিক চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যাচ্ছে, মহামারীর প্রাদুর্ভাব শুরুর পর প্রথম কয়েক মাস দেশের বন্দরগুলোর বেশির ভাগের কার্যক্রমই বেশ নিয়ন্ত্রিত ছিল। এর মধ্যে এপ্রিল ও মে মাসে ১৫টি, জুনে ১৪টি ও জুলাইয়ে ১২টি বন্দরের কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। সংক্রমণ কমে এলে আগস্টের দিকে বন্দরগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে শিথিলতা তৈরি হয়। গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুরোপুরি কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছিল মাত্র তিনটি বন্দরের। বেশির ভাগেরই কার্যক্রম চালু ছিল আংশিক ও পুরোপুরি।
মহামারীর সময়টিতে দেশের প্রবেশমুখগুলো নিয়ন্ত্রিত রাখতে পারলে সংক্রমণও নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতো বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজির আহমেদ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক এ পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) বণিক বার্তাকে বলেন, সম্প্রতি দেশে আন্তঃজেলা যোগাযোগ বন্ধ করায় করোনা সংক্রমণের হার অনেকটাই কমেছে। একই ধরনের ব্যবস্থা যদি আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও নেয়া হতো, তাহলে দ্বিতীয় দফায় দেশের করোনা পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত। বিশেষ করে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের সঠিকভাবে কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশনে রাখার দরকার ছিল। দুঃখজনক হলেও আমরা সেটি নিশ্চিত করতে পারিনি।
ডা. বে-নজির আহমেদের আশঙ্কা, আগামী জুন থেকে দেশে আবার করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে গ্রীষ্মকালেই করোনার সংক্রমণ বেশি হওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। এতে বোঝা যায় আমাদের সামনের দিনগুলো ভালো নাও হতে পারে। মানুষ এখন এলাকাভিত্তিক সংক্রমিত হচ্ছে। বৈজ্ঞানিকভাবে এলাকাভিত্তিক সংক্রমণ ঠেকানো গেলে এ ভয় কম থাকত। ভারতেও ঠিক এমনটা ঘটেছে। তারা একত্র হয়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড করেছিল বলে এখন সংক্রমণ শীর্ষে উঠেছে। আমাদের দেশে অল্প অল্প করে এখন সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখলে এ হার বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
গত বছরের আগস্টে দেশে সংক্রমণ কমতে শুরু করলে স্থলবন্দরগুলোয় স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের ক্ষেত্রে শৈথিল্য চলে আসে। দেশে ভারতের সঙ্গে স্থলবাণিজ্য ও সীমান্তে যাত্রী পারাপারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় বেনাপোল স্থলবন্দর। ভারতে করোনার সংক্রমণ বাড়ায় গত ২৬ এপ্রিল থেকে সীমান্তবর্তী অন্য প্রবেশমুখগুলোর মতো এ স্থলবন্দরেও যাত্রী চলাচল বন্ধ রয়েছে। অথচ এর আগের কয়েক মাস বেনাপোল স্থলবন্দরে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়গুলো মারাত্মকভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। ওই সময় স্থলবন্দরটিতে সাধারণ যাত্রী থেকে শুরু করে পণ্যবাহী গাড়ির চালক-শ্রমিকদের খুব একটা মাস্ক পরতে দেখা যায়নি। অনুসরণ করা হয়নি সামাজিক দূরত্বের নীতিও। এমনকি বন্দর কর্তৃপক্ষও স্বাস্থ্যবিধির বিষয়গুলোয় পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেয়নি। এক পর্যায়ে যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা, জীবাণুনাশক স্প্রে ছিটানোও বন্ধ করে দিয়েছিল বেনাপোল বন্দর কর্তৃপক্ষ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেনাপোল বন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আব্দুল জলিল বলেন, সংক্রমণ যখন বেশি ছিল তখন প্রতিরোধের সব ব্যবস্থা ছিল। সম্প্রতি জনবল সংকটে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে বন্দরে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের সব ব্যবস্থা দ্রুত কার্যকর করা হবে।
বেনাপোল বন্দরের মতোই চিত্র ছিল দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরের। বন্দরটিতেও ভারত থেকে আসা ট্রাকচালক ও হেলপারদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা কম দেখা গেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, কিছুদিন আগেও বন্দরে আসা ভারতীয় ট্রাকচালকরা বন্দরে প্রবেশের পর আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেন না। এমনকি তাদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে গল্প-আড্ডা দিতেন বাংলাদেশী শ্রমিকরা, যাদের অনেকেই মাস্ক ব্যবহার করতেন না। এ দুই বন্দরের মতো একই ধরনের অবস্থা দেখা যায় দেশের প্রায় সব স্থলবন্দরে।
স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে দেশের স্থলবন্দরগুলোর তুলনায় বেশ সতর্ক অবস্থায় ছিল বিমানবন্দরগুলো। যদিও বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশনের বিষয়গুলো খুবই অবহেলিত ছিল।
অনিয়ন্ত্রিত প্রবেশমুখের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের চিত্র ছিল খুবই নাজুক। গণপরিবহন থেকে শুরু করে শপিং মল, কাঁচাবাজার, অফিস-আদালত—স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই ছিল না কোথাও। এমনকি এখনো চলমান কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও ঈদ উদযাপন করতে গাদাগাদি করে বাড়ি ফিরছে হাজারো মানুষ। ফেরিঘাট বা রাজধানীর প্রবেশমুখগুলোয় ঘরমুখী মানুষের ভিড় এখন চোখে পড়ার মতো।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সরকার গঠিত করোনা প্রতিরোধবিষয়ক কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, বিধিনিষেধ বা অন্য ব্যবস্থাগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর হয়নি। যতটুকু হয়েছে তাতে সংক্রমণ কিছুটা কমলেও এখনই চূড়ান্তভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।