সরকারি হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা: চাহিদা অনুযায়ী এখনো কেনা হয়নি জরুরি যন্ত্র ও উপকরণ

চলতি বছরের মার্চে দেশে কভিড-১৯ রোগের দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ শুরু হয়। বাড়তে থাকে শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা। এমন পরিস্থিতিতে সংকটাপন্ন রোগীদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় অক্সিজেন কনসেনট্রেটর, সিলিন্ডার ও হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে বাধাপ্রাপ্ত হয় স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রম। সংকট নিরসনে সে সময়ই প্রান্তিক পর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের জন্য নতুন চাহিদাপত্র তৈরি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে এখন পর্যন্ত সে চাহিদাপত্রের কোনো উপকরণ বা যন্ত্রাংশ কেনা হয়নি। দেশের আট বিভাগের সব সরকারি হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত যন্ত্রাংশ ও উপকরণের চাহিদা কেবল তালিকাবদ্ধ ও অনুমোদন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রয়েছে।

গত মার্চে সংকটাপন্ন করোনা রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে জরুরি যন্ত্রপাতির সংকটে পড়েন দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকরা। সমস্যা সমাধানে দেশের আট বিভাগীয় পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কাছে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সরকারি হাসপাতালগুলোর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির চাহিদা পাঠাতে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সে অনুযায়ী গত ৩ এপ্রিল একটি চাহিদাপত্র তৈরি করা হয়। ১৫ এপ্রিল সেটি কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে পাঠানো হয়। এরপর পেরিয়েছে দুই মাসের বেশি সময়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই চাহিদার কোনো উপকরণ কিনতে ক্রয় আদেশ দেয়া হয়নি।

আট বিভাগের জন্য চাহিদার তালিকায় পাঁচ ধরনের যন্ত্রসহ বেশ কয়েক ধরনের উপকরণের কথা বলা হয়েছে। যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে ৩ হাজার ৯১টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, ২ হাজার ২১৬টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর, ৯৩৭টি আইসিইউ শয্যা (মনিটরসহ), ৭৩৬টি ভেন্টিলেটর ও ২১ হাজার ২৭৯টি অক্সিজেন সিলিন্ডার। সব মিলিয়ে পাঁচ ধরনের যন্ত্রের সংখ্যা ২৮ হাজার ২৫৯টি। এছাড়া ৬ লাখ ৩৩ হাজার ৬৫৯টি রেমডিসিভির ইনজেকশন, ১০ লাখ ৫৯ হাজার ৮১৪টি আরটি-পিসিআর টেস্ট কিট, ২০ লাখ ৩১ হাজার ৩৯৫টি পিপিই কভারঅল (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী) ও ২৩ লাখ ২৩ হাজার ৮১৬টি মাস্কের চাহিদাও দেয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত ১৫ এপ্রিল আট বিভাগের চাহিদার চিঠি পায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরপর অনুমোদনের জন্য তা ২০ এপ্রিল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় থেকে পরে ২২ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে যায় চিঠিটি। ২৮ এপ্রিল ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি চাহিদায় অনুমোদন দিয়ে ৫ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠায়। ৮ মে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন করলে ১২ মে চাহিদাপত্রটি আবার কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে ফিরে আসে।

কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের ক্রয় মূল্যায়ন কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চাহিদার যন্ত্রাংশ ও উপকরণ মোট নয়টি প্যাকেজে কেনা হবে। এসব কেনাকাটার জন্য ৫০০ কোটি টাকা বাজেট ধরা হয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে এসব কেনা হবে। বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি বিভিন্ন নিয়মে দেশ ও বিদেশ থেকে কেনা হয়।

তবে সময় বাঁচাতে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতেও (ডিপিএম) যন্ত্রপাতি কেনার কথা রয়েছে। এখনো ক্রয় আদেশ হয়নি। এ মাসের মধ্যে ক্রয় আদেশ হলেও এসব ঔষধাগারে পৌঁছতে জুলাই বা আগস্ট মাস হয়ে যাবে।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বলছে, কোনো কিছু কেনার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়। এতে কিছুটা সময় লাগে।

মহামারীর সময় জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম ও উপকরণ কিনতে দেরি করাকে মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের অপরাধ হিসেবেই দেখছেন করোনা বিষয়ে সরকারের গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, একে তো চাহিদার তালিকা দেরিতে করা হয়েছে। এরপর সব কার্যালয় ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন শেষ হওয়ার দেড় মাস পরও কেন্দ্রীয় ঔষধাগার ক্রয় আদেশ দিতে পারেনি। তাহলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের কাজ কী, সে প্রশ্ন রাখেন তিনি। দেরি হওয়ার বিষয়টি জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার বলেও মত দেন এ বিশেষজ্ঞ। একই সঙ্গে মহামারীর সময়ে বিভিন্ন কার্যালয়ে অনুমোদনের আনুষ্ঠানিকতা কমিয়ে আনার পরামর্শ দেন তিনি।

এদিকে চাহিদা অনুযায়ী জরুরি এসব যন্ত্রাংশ না পাওয়ায় অন্য উৎস থেকে তা সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা এ চাহিদা দিয়েছি গত এপ্রিলের শুরুতে। এরপর দুই মাসের বেশি সময় গেলেও কিছুই কেনা হয়নি। এসব পেতে আরো দেড় মাসের মতো সময় লাগতে পারে। ফলে বিশ্বব্যাংক, ইউএসএআইডিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে সরাসরি যেসব যন্ত্রাংশ পাওয়া যাচ্ছে তা দিয়েই চিকিৎসা চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। তবে সামনে সংক্রমণ বাড়লে আবারো যন্ত্রপাতির সংকট প্রকট হতে পারে বলে মনে করেন মহাপরিচালক।

জানা গেছে, এ মুহূর্তে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে বর্তমানে অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার, অক্সিজেন কনসেনট্রেটর রয়েছে ৭০০, আইসিইউ শয্যা ১২০টি। তবে হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, ভেন্টিলেটর, পিসিআর পরীক্ষার কিট, রেমডিসিভির ইনজেকশন শেষ হয়ে গেছে। ফলে করোনার সংক্রমণ বাড়লে এসব সামগ্রীর অভাবে চিকিৎসা ব্যাহত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কাজের ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ হয়নি বলে দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা সব কাজই দ্রুত করেছি। শিগগিরই ক্রয় আদেশ দেয়া হবে। আগামী মাসেই এসব উপকরণ চলে আসবে বলেও জানান তিনি।

Source: Bonik Barta

Share the Post: