দেশে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে গত ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় গণটিকাদান কর্মসূচি। সে সময় ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছিল। তবে মাঝপথে হঠাৎ ভারত টিকা রফতানি বন্ধ করে দিলে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে টিকাদান কর্মসূচি। কোভিশিল্ড টিকার যে মজুদ আছে, সেগুলো এখন বেশ হিসাব করেই দেয়া হচ্ছে। এজন্য শুরুতে প্রথম ডোজ যারা নিয়েছিলেন তারাই কেবল দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে এ টিকা পাচ্ছেন। সে হিসেবে প্রথম ডোজ পাওয়া ষাটোর্ধ্বদের ৪০ শতাংশই দ্বিতীয় ডোজ পাননি। অথচ বয়স বিবেচনায় তারাই সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন।
যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে ঝুঁকিপূর্ণরা দ্বিতীয় ডোজের টিকা সময়মতো পাচ্ছেন না বলে মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারের গঠিত করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ষাটোর্ধ্বদের বিশেষ বিবেচনায় পূর্ণাঙ্গ ডোজ টিকা প্রয়োগ প্রয়োজন। কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম। ফলে যেকোনো ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি তাদের বেশি থাকে। একই সঙ্গে সংক্রমিত হলে তাদের মৃত্যুও বেশি হয়। সে কারণে টিকা প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেয়ার দরকার ছিল।
অবশ্য শুরুতে বাংলাদেশে কভিড-১৯ প্রতিরোধী টিকাদান কার্যক্রমের পরিকল্পনা ছিল ষাটোর্ধ্বদের টিকার আওতায় আনা। পরবর্তী সময়ে ৪০ বছরের বেশি বয়সী ও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ২০ শ্রেণী-পেশার মানুষের টিকা প্রাপ্তির জন্য অনলাইনে নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু হয়। নিবন্ধন কার্যক্রম চলমান রেখেই গত ফেব্রুয়ারিতে সারা দেশে গণপরিসরে কোভিশিল্ড টিকা প্রয়োগের কার্যক্রম শুরু করে সরকার। এরপর গত ৮ এপ্রিল ঘাটতি নিয়েই দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ শুরু করা হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণে টিকার সংস্থান না হওয়ায় গত ২৬ এপ্রিল থেকে প্রথম ডোজ প্রয়োগ বন্ধ করে সরকার। পরে নিবন্ধন কার্যক্রমও বন্ধ করে দেয়া হয়।
সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পরবর্তী সময়ে পর্যাপ্তসংখ্যক টিকা হাতে পাওয়ার পর আবার নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হবে। হিসাব অনুযায়ী মজুদ থাকা টিকা প্রয়োগ শেষ হলে প্রথম ডোজ পাওয়া সাড়ে ১৪ লাখ ব্যক্তি দ্বিতীয় ডোজের টিকা পাবেন না। ঘাটতি থাকা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ডোজের সংস্থান হলে অপেক্ষমাণদের শরীরে তা প্রয়োগ করা হবে। যদিও কবে নাগাদ এ টিকা আসবে তা জানে না খোদ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ১৪ জুন পর্যন্ত দেশে মোট ৫৮ লাখ ২০ হাজার ১৫ জন কোভিশিল্ড টিকা পেয়েছেন। এর মধ্যে দ্বিতীয় ডোজের টিকা পেয়েছেন ৪২ লাখ ৫৩ হাজার ৫২৬ জন।
১৪ জুন পর্যন্ত ষাটোর্ধ্ব ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৬ লাখ ৭৫ হাজার ৭৯ জন নারী ও পুরুষ দ্বিতীয় ডোজের টিকা পেয়েছেন। তবে এ বয়সীদের প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছেন ১১ লাখ ৩৫ হাজার ২৮ জন। ফলে প্রথম ডোজ পাওয়াদের মধ্যে ৪ লাখ ৫৯ হাজার ৯৪৯ জন দ্বিতীয় ডোজের টিকা পাননি, যা শতাংশের হিসাবে ৪০ দশমিক ৫৩। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে প্রায় ৮৬ হাজার, বরিশালে সাড়ে ১৯ হাজার, চট্টগ্রামে সাড়ে ৯৭ হাজার, খুলনায় সাড়ে ৬৮ হাজার, ময়মনসিংহে ৩৪ হাজার, রাজশাহীতে সাড়ে ৬৫ হাজার, রংপুরে সাড়ে ৬৬ হাজার ও সিলেটে সাড়ে ২২ হাজার ষাটোর্ধ্ব নারী-পুরুষ দ্বিতীয় ডোজের টিকা পাননি। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশে করোনা পজিটিভ ষাটোর্ধ্বদের মৃত্যুর হার ৫৭ শতাংশ।
সমন্বিতভাবে টিকা প্রাপ্তির তথ্য বিশ্লেষণ করে ঝুঁকিপূর্ণদের অগ্রাধিকার দেয়ার প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, প্রথম ডোজ পাওয়া ষাটোর্ধ্বদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ডোজ নিশ্চিত করা যেত। সেক্ষেত্রে প্রথম ডোজপ্রাপ্তদের তথ্য বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন ছিল। সে তথ্য সমন্বিতভাবে বিশ্লেষণ করা হয়নি। একই সঙ্গে আমরা যখন নিশ্চিত হতে পারলাম না ভারত থেকে নিয়মিতভাবে টিকা পাচ্ছি, তখনই প্রথম ডোজ প্রয়োগ বন্ধ করা দরকার ছিল; কিন্তু তা করা হয়নি। যখন করা হয়েছে তখন ঘাটতি আরো বেশি দাঁড়িয়েছে। পরিকল্পনার অভাবে এমনটি হয়েছে।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করেছি। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে টিকার ঘাটতি হয়েছে। যত শিগগির সম্ভব কোভিশিল্ড টিকা পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ টিকা পেলে ষাটোর্ধ্বদেরই আগে দেয়া হবে।