গোটা দেশেই এখন নার্স সংকট প্রকট রূপ ধারণ করেছে। নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন নার্সের প্রয়োজন তিন লাখের বেশি। যদিও নিবন্ধিত নার্স আছেন ৮৪ হাজার। সে হিসেবে দেশে নার্স আছে প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র ২৮ শতাংশ। প্রতি চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স থাকার কথা থাকলেও রয়েছেন দশমিক ৩০ জন। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে ২৩ জন নার্স থাকার কথা। যদিও বাংলাদেশে এ সংখ্যা তিনজন।
সব মিলিয়ে কাজের বাড়তি চাপ নিয়েই হাসপাতালগুলোয় সেবা দিচ্ছেন নার্সরা। এর মধ্যেও সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বৈরিতা, উপযুক্ত পরিবেশের অভাব, রোগীর স্বজনদের দুর্ব্যবহার, প্রাতিষ্ঠানিক অস্বচ্ছতা, পদোন্নতির ঘাটতিসহ কর্মক্ষেত্রে নানা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয় তাদের। পেশাগত জীবনে এমন নানামুখী চাপ প্রভাব ফেলছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। স্বাস্থ্য খাতের অপরিহার্য এ কর্মী বাহিনীর অধিকাংশকেই এখন নানামুখী মানসিক স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, স্বাস্থ্যসেবা একটি দলগত প্রচেষ্টা। এ দলের প্রধান চিকিৎসক আর দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন নার্স। এখানে চিকিৎসকরা রোগীর রোগের ধরন এবং কী ধরনের চিকিৎসা লাগবে সেটি নির্ধারণ করেন। আর নার্সরা সে নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করেন। এজন্য নার্সদের পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি রোগীর সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিতে শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্য এবং সামাজিকভাবে সুস্থ জীবনযাপনের অধিকারী হতে হবে। এ মানসিক সুস্বাস্থ্য বিঘ্নিত হলে তারা সুচারুভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। এ কারণে পৃথিবীর সব দেশে চিকিৎসক ও নার্সদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়।
চাপমুক্ত সুন্দর কর্মক্ষেত্রকে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার অন্যতম প্রভাবক হিসেবে দেখছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স থাকতে হয়। সেখানে বাংলাদেশ গড়ে দুজন চিকিৎসকের বিপরীতে একজন নার্স রয়েছেন। অর্থাৎ একজন নার্সের কাজের বোঝা যতটুকু থাকা দরকার, তার চেয়ে ছয় গুণ বেশি টানতে হচ্ছে তাদের। এ কাজের বোঝা তাদের ক্লান্ত করে থাকে। উৎসাহ-উদ্দীপনাকে শ্লথ করে দেয়। এ কাজের বোঝা টানতে গিয়ে তারা রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে যেমন নার্সসুলভ আচরণ করার কথা, সেটি করতে পারেন না।’
তিনি আরো বলেন, ‘পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নার্সদের যেমন মর্যাদা রয়েছে বাংলাদেশে তেমন নেই। সামাজিকভাবেও তারা অবমূল্যায়িত। সামাজিকভাবে ক্ষমতাবানরা তাদের কিছুটা তাচ্ছিল্যের চোখেও দেখে। নার্সরা ভালো না থাকলে রোগী ভালো সেবা পাবে না। এজন্য পর্যাপ্ত নার্স নিয়োগ দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যথাযথ পদায়নের জায়গা নিশ্চিত করতে হবে।’
২০২১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৮৬ শতাংশ নার্স অনুপযুক্ত পরিবেশে কাজ করছেন। কোলাহলমুখর, স্বল্প আলো, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও অপর্যাপ্ত বায়ুপ্রবাহের মধ্যে দিনের পর দিন কাজ করে যাচ্ছেন তারা। এর পরেও কর্মজীবনে পদোন্নতি পান না ৭০ শতাংশ নার্স। পদোন্নতি না পাওয়া এসব স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এ পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন ১০-২০ বছর ধরে। এর সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত কাজের চাপ, প্রাতিষ্ঠানিক দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন কারণে তাদের মধ্যে পেশাগত চাপ তৈরি হয়, যা তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে নার্সের কাজ করছেন মিরা রায়। তার মতে, নার্সের সংখ্যা এখন একদমই যে কম তা নয়। তবে কিছু কিছু জায়গায় নার্সের সংখ্যা কম রয়েছে। প্রশিক্ষণ ও পদায়নের ক্ষেত্রে নার্সরা সমস্যা পড়েন। অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। এমনও হয়েছে, এক পদে থেকে বহু নার্স অবসরে গেছেন।
নার্সদের অধিকার রক্ষায় গঠিত সংগঠন সোসাইটি ফর নার্স সেফটি অ্যান্ড রাইটস বলছে, অতিরিক্ত চাপের মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশে অর্ধেকের বেশি নার্স মানসিক নানা জটিলতায় ভুগছেন। বিষণ্নতা-উদ্বেগ ও চাপ নিয়েই সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারা।
সংগঠনটির মহাসচিব ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নার্স সাব্বির মাহমুদ তিহান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নার্সদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য আমরা সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তবে এসব বিষয় সমাধানের জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার শিকার হওয়ার পাশাপাশি নিরাপত্তা ও পর্যাপ্তসংখ্যক নার্সের সংকট রয়েছে। নার্সদের যে পরিমাণ রোগী নিয়ে কাজ করার কথা, তার চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি রোগী নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। পদ-পদবি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে নার্সদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। এখনো নার্সিং ও মিডওয়াইফদের কোনো চূড়ান্ত অর্গানোগ্রাম হয়নি। পদোন্নতির সংখ্যাও খুবই কম। এসব কিছুই এখন হয়ে উঠছে নার্সদের মানসিক বিপর্যয়ের কারণ।’
দেশের চার বিশ্ববিদ্যালয় ও নার্সিং ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞদের পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, পেশাগত কাজ করতে গিয়ে নার্সদের ৫১ শতাংশ উদ্বেগ ও বিষণ্নতার মতো মানসিক ব্যাধিতে ভুগছেন। মানসিকভাবে অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতির মধ্যে দিন পার করছেন ৬০ শতাংশ নার্স। শারীরিক বা পরিবেশগতভাবে দুর্বল অবস্থায় রয়েছেন ৪২ শতাংশ। সামাজিকভাবে বিভিন্ন কার্যক্রম যুক্ত হতে পেরেছেন মাত্র ৪৮ শতাংশ নার্স। ২০ শতাংশের মধ্যে বিষণ্নতা কাজ করছে।
চার মাস ধরে বিভিন্ন পদ্ধতিতে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ হয়েছে ‘মেন্টাল হেলথ স্ট্যাটাস অ্যামাঙ দ্য নার্সেস ওয়ার্কিং অ্যাট আ টারশিয়ারি লেভেল হসপিটাল ইন ঢাকা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে। আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্নাল ‘ওআইআরটি জার্নাল অব মেডিকেল অ্যান্ড হেলথ সায়েন্সস’-এ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষকদের অন্যতম ইবনে কায়েস বণিক বার্তাকে জানান, নার্সরা কর্মক্ষেত্রে কী অবস্থায় কাজ করছেন, মানসিক স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে তাদের অবস্থা কেমন তা দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। দেশে রোগীর সংখ্যার অনুপাতে নার্সের সংখ্যা খুবই কম। নার্সদের মানসিক স্বাস্থ্যগত বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করলে স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে তাদের ভূমিকা নেতিবাচক হবে। নার্সদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সরকারকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ-সেমিনারসহ কর্মপরিধি বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) রাশিদা আক্তার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আশা করি পাঁচ বছরের মধ্যে জনসংখ্যার বিপরীতে নার্সের ঘাটতি কিছুটা কমে আসবে। এছাড়া নার্সিংয়ে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষাক্রম প্রস্তুত করা হয়েছে, যা প্রশাসনিক অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এ কারিকুলাম চালু হলে নার্সরা তাদের নিজেদের ও অন্যের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে নার্সদের মানসিক স্বাস্থ্যে গুরুত্ব দেয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, নার্সদের কাজের চাপ ও কর্মঘণ্টা হ্রাস এবং যথাযথ পরিমাণে সংখ্যা বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়া প্রয়োজন। সামাজিক কার্যক্রমেও নার্সদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘নার্সদের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। তাদের ওপর কাজের চাপ বেশি। পছন্দের জায়গায় পদায়ন নিয়েও কিছুটা চাপ তারা অনুভব করতে পারেন। কারণ অনেকের স্বামী-সন্তান ভিন্ন জায়গায় থাকে। আমরাও অনেক নার্সকে তাদের কাঙ্ক্ষিত জায়গায় দিতে পারছি না। কারণ তারা যেসব জায়গায় যেতে চাচ্ছেন, সেখানে হয়তো পদ খালি বা চাহিদা নেই। বর্তমানে নতুন করে আরো ১০ হাজার নার্স নিয়োগের কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে। এছাড়া আরো চার হাজার নার্স নিয়োগের চাহিদা দেয়া হয়েছে।’