অনলাইন ফার্মেসিতে তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি: সাতটি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন থাকলেও চলছে শতাধিক

দেশে দিন দিন অনলাইনের পরিসর বাড়ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণ থেকে শুরু করে জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী পর্যন্ত কেনাবেচা হচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমে। চলমান করোনা মহামারীতে অনলাইনের ক্ষেত্র আগের চেয়ে তিন গুণ বেড়েছে। এ অবস্থায় অনলাইন ফার্মেসির সংখ্যা বেড়েছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরে অনুমোদন ছাড়াই শতাধিক অনলাইন ফার্মেসি গড়ে উঠেছে। অথচ সাতটি ওষুধ বিপণন প্রতিষ্ঠানের ১৫টি ফার্মেসির অনলাইন অনুমোদন রয়েছে। অনুমোদনহীন এসব ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে প্রতারিত হচ্ছে গ্রাহক। গুরুত্বপূর্ণ এ পণ্য বাজারজাতে ঔষধ প্রশাসনের তদারকি না থাকায় স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

জানা যায়, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে অনলাইন ফার্মেসির যাত্রা হয়। ওই বছরের মাঝামাঝিতে অনলাইন ফার্মেসির জন্য ‘অনলাইনভিত্তিক ফার্মেসি সেবা প্রদান’ বা এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর) প্রণয়ন করে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ)। ২০২২ সালের জুলাইয়ে এসওপি রিভিউর তারিখ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অনলাইনে বিক্রি করছে ওষুধ। তবে রাজধানীসহ সারা দেশে অনুমোদনহীন শতাধিক অনলাইন ফার্মেসি রয়েছে। এসবের কোনোটি আবার তিন বছরের বেশি সময় ধরে ঔষধ প্রশাসনের চোখের সামনেই অনলাইনে ওষুধ বিক্রি করছে।

অনলাইনে পাওয়া অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ভোক্তার কাছে স্বল্প সময়ে যথাযথ ওষুধ পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে—এমনটি উল্লেখ রয়েছে ঔষধ প্রশাসন প্রণীত নীতিমালায়। অনলাইনে ওষুধ বিক্রি করতে হলে অবশ্যই অধিদপ্তরের অনুমোদন নিতে হবে। এছাড়া ফার্মেসির ধরন, লে-আউট, ওষুধ সংরক্ষণ ব্যবস্থা, সরবরাহ, রেকর্ড সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপত্রের জন্য নির্দেশনা এবং সরবরাহে সীমাবদ্ধতাসহ বেশ কয়েকটি নির্দেশনার কথা এতে রয়েছে। এসব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনলাইনে ওষুধ বিক্রির অনুমোদন দেয়া হয়।

ঔষধ প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত দেড় বছরে দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানকে অনলাইনে ওষুধ বিক্রির অনুমোদন দেয়া হয়নি। এর আগ পর্যন্ত সাতটি প্রতিষ্ঠানের ১৫টি ফার্মেসিকে এ অনুমোদন দেয়া হয়। এগুলো হলো ডায়াবেটিস স্টোর, আর্ত বাংলাদেশ পেসেন্ট সাপোর্ট নেটওয়ার্ক, ই-ফার্মা, ইয়েস বিডিডটকম, লাজ ফার্মা ও ইউনাইটেড হাসপাতাল ফার্মেসি এবং সোর্স কো লিমিটেডের রয়েছে নয়টি অনুমোদন। এসব প্রতিষ্ঠানকে একটি নির্দিষ্ট ঠিকানার অনুকূলে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তবে অন্য কোনো ঠিকানা বা শাখা থেকে তারা অনলাইনের মাধ্যমে অনুরোধ নিয়ে ওষুধ বিক্রি করতে পারবে না। এছাড়া ফিজিশিয়ান স্যাম্পল কেনাবেচা না করা, ওষুধ ব্যতীত অন্য কোনো পণ্য বিক্রি না করা, নির্ধারিত মূল্যের বেশি না রাখাসহ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। তবে এসব ফার্মেসি কোনোভাবেই চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ সরবরাহ করবে না।

এর বাইরে ওয়েবসাইট, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে শতাধিক ফার্মেসি ওষুধ বিক্রি করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে লাইসেন্স নাম্বার পাওয়া যায়নি। ওয়েবসাইট ব্যবহার করে ওষুধ বিক্রির পাশাপাশি শিশুখাদ্য ও চিকিৎসা সরঞ্জামও বিক্রি করা হচ্ছে, যা ফার্মেসিতে বিক্রি নিষিদ্ধ। এসব অনলাইন ফার্মেসিতে নেই রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্টের তত্ত্বাবধান, ওষুধ সংরক্ষণ ও সরবরাহ ব্যবস্থা। অনুমোদন ছাড়াই ওষুধ বিপণনে বড় বড় প্রতিষ্ঠানকেও দেখা যায়।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, অনুমোদনের বিষয়টি কঠিন নয়। শর্ত মানলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুমোদন দেয়া হয়। কোনো প্রতিষ্ঠান আবেদন করলেই তখন অনুমোদন দেয়া হবে কিনা তা বিবেচনা করা হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সাল পর্যন্ত অনলাইন ফার্মেসির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। গত দেড় বছরে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানকে অনলাইনে ওষুধ বিক্রির অনুমতি দেয়া হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু অনলাইনেই নয়, ওষুধ বিক্রির বিষয়টি কঠোরভাবে তদারক করতে হয়। এর বিচ্যুতি হলে বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়। যে কেউ অনলাইনে অনুরোধ করে ইচ্ছেমতো ওষুধ পেয়ে গেলে তাতে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনলাইন ফার্মেসির অনুমোদন দেয়া হলেও তা খুবই সীমিত পরিসরে। সেসব ক্ষেত্রে কঠোর তদারকি থাকে। তবে বাংলাদেশে অনুমোদন ছাড়া কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই এসব চলছে। বিষয়টি যে অন্যান্য পণ্য বিক্রির মতো নয়, তা যেন বুঝতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।

তদারকি না থাকার কারণে অনলাইনে যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই ফার্মেসি গড়ে উঠেছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হাসপাতাল, ফার্মেসির মতো অনলাইন ফার্মেসির বিষয়েও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকি নেই। ঔষধ প্রশাসন সাধারণ ফার্মেসিকেই নজরদারির আওতায় আনতে পারেনি, সেখানে অনলাইনের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করা তাদের জন্য দুরূহ। এভাবে চলতে থাকলে নিয়ন্ত্রণ আরো কঠিন হবে। তখন একদিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য অভিযান চললেও অন্যদিকে দেখা যাবে অনুমোদনহীন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে।’ অনলাইন ফার্মেসির কারণে অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার বাড়ছে বলেও মন্তব্য করেন এ বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার বেশি হয় অনুমোদনহীন ফার্মেসি, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র না থাকা ও প্রশাসনের নজারদারির অভাবে।’

দেশে প্রথম অনলাইন ফার্মেসি ডায়াবেটিস স্টোর লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ই-ক্যাবের সহসভাপতি সাহাব উদ্দিন শিপন জানান, করোনার সময়ে অনলাইনে ওষুধ বিক্রি দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। লক্ষাধিক গ্রাহক অনলাইনে অনুরোধ করে সেবা নেয়। অনুমোদিত অনলাইন ফার্মেসি রয়েছে ১৫টি। তবে দেশে অনুমোদনহীন শতাধিক অনলাইন ফার্মেসি রয়েছে।

অনুমোদন ছাড়া অনলাইন ফার্মেসির বিষয়ে পদক্ষেপের বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অনলাইন ফার্মেসির বিষয়টিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে উৎসাহ দিই না। কারণ অনুমোদন থাকলেও নিয়ন্ত্রণ করা সহজ নয়। এখন অনলাইনের ব্যবহার বেড়েছে বলে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। তবে তা যেখানে সেখানে নয়। নিয়ম মেনে দেয়া হয়। আমরা অনুমোদনহীন অনলাইন ফার্মেসির বিষয়ে শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করে ব্যবস্থা নেব।’

Source: Bonik Barta

Share the Post: