- দেশে ২০১৫ সাল থেকে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বাড়ছে।
- বিশ্বের মধ্যে এই ভাইরাসে মৃত্যুহারে বাংলাদেশ শীর্ষে।
- মশা নির্মূল ও রোগী ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি এবং জলবায়ুকে দুষছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় ছয় দশক আগে। সে সময় রোগটি ‘ঢাকা ফিভার’ নামে পরিচিতি পায়। ২০০০ সালে এসে এডিস মশাবাহিত এই ভাইরাস ডেঙ্গু নামে সরকারের গুরুত্ব পায়। তারপর পেরিয়েছে দুই যুগ। দিনে দিনে ভাইরাসটির সংক্রমণ বেড়েছে। মৌসুমি রোগ থেকে ডেঙ্গু হয়ে উঠেছে সারা বছরের রোগ। তবে এক দশক ধরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মশকনিধন ও রোগী ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণগুলোকে দায়ী করেছেন।
রোগতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশের রোগ ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার বাংলাদেশেই বেশি। শতাধিক দেশে এই রোগের বিস্তার থাকলেও সেসব দেশে মৃত্যুহার তুলনামূলক কম। দুই যুগ ধরে বাংলাদেশ ডেঙ্গু মোকাবিলা করলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে এই রোগের বিস্তার ঠেকাতে বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপে ঘাটতি রয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বছরভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে ২০০০ সাল সাড়ে ৫ হাজার ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়, মৃত্যু হয় ৯৩ জনের। মৃত্যুহার ছিল শতকরা ১ দশমিক ৬৭ জন। এরপর ২০০৬ সাল পর্যন্ত কোনো বছর মৃত্যুহার ছিল ২ শতাংশ, কোনো বছর তা শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে কোনো মৃত্যু ঘটেনি। ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত মৃত্যুহার ছিল ১ শতাংশের কম। ২০১৪ সালেও কোনো মৃত্যু হয়নি। কিন্তু এর পর থেকেই দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। মাঝে কেবল ২০১৯ সালে মৃত্যুহার কমেছিল।
দেশে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২০২৩ সালে, ৩ লাখ ২১ হাজার জন। ওই বছর মৃত্যু হয়েছিল ১ হাজার ৭০০ রোগীর। মৃত্যুহার ছিল শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ। আর চলতি বছর ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত ৫৪ হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, মারা গেছে ২৬৮ জন।
ডব্লিউএইচও বলছে, বাংলাদেশে পাঁচ বছর ধরে এডিস মশার ঘনত্ব এবং সম্ভাব্য হটস্পট বাড়ছে। আর্দ্রতার সঙ্গে অস্বাভাবিক বৃষ্টি সারা দেশে মশার সংখ্যা বাড়িয়েছে। পাশাপাশি জলাবদ্ধতা, বন্যা, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও ঋতুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনও ভূমিকা রেখেছে।
মেডিকেল এন্টোমলজিস্ট ও জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. গোলাম সারোয়ার আজকের পত্রিকাকে বলেন, পরিবর্তিত পরিবেশ এডিস মশার স্বভাব ও ভাইরাসের শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমান আবহাওয়া শুধু যে এডিস মশা বৃদ্ধির জন্য উপযোগী তা নয়, বরং মশার মধ্যে ভাইরাসের মিউটেশন (রূপান্তর) বেশি হচ্ছে। এতে আক্রমণের তীব্রতা বেড়েছে, পরিবর্তন হয়েছে মশার স্বভাব। মশা নির্মূলে যে কীটনাশক দেওয়া হচ্ছে, তা কাজে আসছে না। বরং মশার জন্য যেসব পরিবেশ ক্ষতিকর, তা ধ্বংস হচ্ছে। এতে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার বাড়ছে।
বৈশ্বিকভাবে ডেঙ্গুতে বাংলাদেশে মৃত্যুহার শীর্ষে বলে ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোলের (ইসিডিসি) তথ্য বিশ্লেষণেও পাওয়া গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই সংস্থাটি বলছে, চলতি বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেড় কোটি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট মৃত্যু ৬ হাজার। এই দেড় কোটি রোগীর বেশির ভাগই দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশের বাসিন্দা। এর মধ্যে ১ কোটিই ব্রাজিলের রোগী। ১০ লাখ রোগী দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য দেশের। দক্ষিণ আমেরিকার এসব দেশে রোগীর বিপরীতে মৃত্যুহার শতকরা শূন্য দশমিক শূন্য ৫৭ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশে এই হার শূন্য দশমিক ৪৯ শতাংশ।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও সংস্থাটির পরামর্শক মুশতাক হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যে সংখ্যক রোগীর তথ্য আমরা সরকারের পক্ষ থেকে পাচ্ছি, প্রকৃত রোগী তার কয়েক গুণ বেশি। যারা হাসপাতাল ভর্তি হচ্ছে তাদের সংখ্যাই আমরা জানি। এর বাইরে বহু রোগী বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছে, মারা যাচ্ছে, সেই সংখ্যা আমাদের জানা নেই। তা ছাড়া, শনাক্ত হয়নি কিন্তু ডেঙ্গু আক্রান্ত—এমন রোগীর সংখ্যাও কম নয়। আমরা বহু বছর ধরে বলে আসছি, মশা নির্মূল ও রোগী ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে হচ্ছে না। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়নি। এটাও একটি বড় সমস্যা।’
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) শেখ দাউদ আদনান দাবি করেছেন, সারা দেশে একই চিকিৎসা প্রটোকল (চিকিৎসা নির্দেশিকা) মেনে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা চিকিৎসা প্রটোকল রিভাইস করছি। হাসপাতালে রোগী ব্যবস্থাপনায় কোনো ঘাটতি নেই।’
আরও ৪ জনের মৃত্যু
দেশে ডেঙ্গুতে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ২৬৮ জন হলো। ওই ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ২৯ জন। এ নিয়ে এ বছর মোট হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে হলো ৫৪ হাজার ২২৫ জন। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।