মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসার জন্য যান জুয়েল আহমেদ। প্রথমে চিকিৎসক পাননি। কর্তব্যরত নার্স জীবাণুনাশক তরল দিয়ে তার ক্ষতস্থান পরিষ্কার করেন। তবে টারশিয়ারি (চিকিৎসাসেবায় শীর্ষ) পর্যায়ের এ হাসপাতালটিতে এক্স-রে মেশিন নষ্ট থাকায় তাকে অন্য একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে নিরীক্ষণটি করিয়ে আনতে হয়।
চর্মরোগের উপসর্গ নিয়ে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসার জন্য আসেন মতিউর রহমান। অপ্রত্যাশিত সময় ব্যয়ের পর চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র পেলেও তাতে কোনো রোগের নাম উল্লেখ ছিল না।
অপরিহার্য স্বাস্থ্য পরিষেবা নিতে গিয়ে এভাবেই নানা দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ। গত এক দশকে অপরিহার্য স্বাস্থ্য পরিষেবায় এগিয়ে এলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। চলতি বছর জুনে জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) ‘অ্যাকসিলেটিং প্রোগ্রেস টুয়ার্ডস ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ ফর এ হেলদিয়ার বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। ২০১০-২০ পর্যন্ত অপরিহার্য স্বাস্থ্য পরিষেবার অবস্থান পরিবর্তনের কথা এতে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনটি বলছে, ২০১০-২০ সালে দক্ষিণ এশিয়ার ১১টি দেশের সবগুলোই অপরিহার্য স্বাস্থ্য পরিষেবায় উন্নতি করেছে। থাইল্যান্ডে শতকরা ৮২, উত্তর কোরিয়া ৭২, শ্রীলংকা ৬৬, ভুটান ৬৪, ভারত ৬৩, ইন্দোনেশিয়া ও মালদ্বীপ ৬২, মিয়ানমার ৫৬, পূর্ব তিমুর ৫৫, নেপাল ও বাংলাদেশ ৪৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ১০ বছরে উন্নতি করেছে তবে এখনো অর্ধেক মানুষের কাছে অপরিহার্য স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে পারেনি। এতে সেবার মধ্যম মান, অর্থায়ন এবং শাসন ব্যবস্থা উপাদান হিসেবে কাজ করছে। তবে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায় এগিয়ে যেতে এখনো কিছু উপায় রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বেড়েছে। তবে গ্রামের চেয়ে শহরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ভঙ্গুর এবং সমন্বয়হীন। মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা বিভিন্ন আর্থসামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। মাত্র ১৭ শতাংশ দরিদ্র নারী চারবার প্রসবপূর্ব সেবা (অ্যান্টিনাটাল কেয়ার) পেয়ে থাকেন। যেখানে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকা নারীদের ৬৬ শতাংশ সেবাটি পাচ্ছেন। দরিদ্র নারীদের মধ্যে কেবল ৩২ শতাংশ দক্ষ প্রসূতিসেবা পান।
নগর অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগোপযোগী পরিকল্পনা নেই উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের শহরগুলোতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মান ও পরিধি গ্রামাঞ্চলের চেয়ে কম। স্থানীয় সরকারি বিভাগ বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছে না। তাদের লোকবলও নেই। ফলে সরকার বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিষয়ক স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি হাতে নিলেও তার সঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
সরকারের চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি অনুযায়ী, মাতৃ, নবজাতক, শিশু এবং কৈশোর স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, পুষ্টি, সংক্রামক রোগ, অসংক্রামক রোগ এবং অন্যান্য সাধারণ ব্যবস্থাপনার মধ্যে ২৭ ধরনের অপরিহার্য স্বাস্থ্যসেবার কথা বলা হয়েছে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন মেয়াদি কর্মসূচি মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। তবে মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে তাচ্ছিল্যের শিকার হচ্ছেন বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশ সংক্রামক রোগে আক্রান্তের আধিক্য থেকে অসংক্রামক রোগের দিকে ধাবিত হয়েছে। হূদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ বেড়েছে। এতে চিকিৎসাসেবা নিতে মানুষের ব্যয় বেড়েছে। মারা যাওয়াদের মধ্যে ৬৭ শতাংশই অসংক্রামক রোগের শিকার। এ মুহূর্তে জরুরি পদক্ষেপ না নিলে বিপর্যয়কর স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় মেটাতে মানুষ ২০৩০ সালের মধ্যে আরো দারিদ্র্যের মধ্যে পড়বে।
ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাস্থ্যসেবায় লোকবলের সংকট রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ৬ দশমিক ৭৩ জন। আর সরকারি চিকিৎসক ১ দশমিক ৫৫ জন ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট শূন্য দশমিক ৬০ জন। সরকারি হাসপাতালে প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে ৩ দশমিক ৩০টি শয্যা থাকলেও বেসরকারি হাসপাতালে ৫ দশমিক ৫৩টি শয্যা রয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা মানবসম্পদে পিছিয়ে রয়েছি। চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিতদের যথাযথ প্রশিক্ষণ নেই। রোগ প্রতিরোধ, রোগী ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তাদের ধারণা কম। দৃষ্টিভঙ্গি হলো চিকিৎসা করলে ভালো হয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য আমাদের নেয়া উদ্যোগটি আগের। এখন প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। স্বাস্থ্য খাতকে বাজেটে প্রাধান্য দেয়া উচিত। একই সঙ্গে যারা সেবা নিতে আসবেন, তাদের বুঝতে হবে এটা তাদের অধিকার।