হাওরবেষ্টিত জেলা সুনামগঞ্জ। জেলাটি প্রতি বছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছে। বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে জেলার প্রায় সব কৃষিজমি। নষ্ট হচ্ছে লাখ লাখ হেক্টর জমির ফসল। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জেলার বাসিন্দাদের সার্বিক খাদ্যনিরাপত্তা। সারা দেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার দিক থেকে জেলাটি এখন দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। ১০ বছর ধরে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে দেখা গেছে, পর্যাপ্ত ও মানসম্মত খাবারের অভাব নিয়ে বছরের অর্ধেক সময় পার করে জেলার প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ বাসিন্দা, যা জেলার মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ।
সাম্প্রতিক বন্যায় সুনামগঞ্জের প্রায় শতভাগ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে বলে সরেজমিন দেখা গিয়েছে। এছাড়া অন্যান্য বছরের মার্চের শুরু থেকে আগস্ট পর্যন্ত জেলার বাসিন্দারা বন্যাদুর্গত হচ্ছেন। সদর উপজেলা উঁচু এলাকা হলেও বাকি ১১টি উপজেলা নিচু। এর মধ্যে ধরমপাশা, মধ্যনগর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, দিরাই, শাল্লা উপজেলা হাওর এলাকা। এসব অঞ্চলে বছরের প্রায় আট মাস পানিতে প্লাবিত থাকে। বাসিন্দারা মাছ শিকার করে তা বিক্রি করেই খাবারের সংস্থান করেন। আর ভাতের জন্য তারা মূলত বোরো ধানের ওপর নির্ভরশীল। বন্যায় বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হলে স্থানীয়দের মধ্যেও খাদ্যের অভাব দেখা দেয়। গুরুতর ও দীর্ঘমেয়াদি এ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী জেলার নারী ও শিশুরা। খাদ্যের পর্যাপ্ততা ও মান নিশ্চিত না হওয়ায় অপুষ্টি ও দীর্ঘমেয়াদি নানা রোগে ভুগছে এ অঞ্চলের অনেক বাসিন্দা।
বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন (আইপিসি)। ২০০৯-১৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছর সময় নিয়ে দেশের সব জেলার খাদ্যনিরাপত্তার চিত্র বিশ্লেষণ করেছে সংস্থাটি। ওই বিশ্লেষণে দেখা যায়, গুরুতর ও মাঝারি দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার অন্যতম জেলা সুনামগঞ্জ। এখানকার মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ বা সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ গুরুতর দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এসব মানুষ বছরের চার মাস বা তার বেশি সময় এক বেলা খাবারের সংকটে ভুগছে। আর ১৫ শতাংশ বা চার লাখের বেশি মানুষ মধ্যম দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তারা বছরের দুই-চার মাস খাবারের অভাবে থাকে। তবে জেলার ৩৫ শতাংশ বাসিন্দা বা পৌনে ১০ লাখ মানুষ মৃদু দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। আর বাকি ৩০ শতাংশ বা ৮ লাখ ৩০ হাজার মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা ঠিক রয়েছে।
কৃষি ও মাছ শিকারের ওপর নির্ভরশীল সুনামগঞ্জের প্রতি ১০টি খানার মধ্যে ছয়টি নিম্ন আয়ের। তাদের আয়ের উৎসও তেমন একটা স্থিতিশীল নয়। প্রতি বছরই বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জেলার ২০ শতাংশ বাসিন্দা এখন বাস করছে চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে। গুরুতর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার কারণে জেলার ৭০ শতাংশ নারী ও শিশু পর্যাপ্ত বৈচিত্র্যময় খাবার খেতে পারছেন না। জেলার দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ শিক্ষিত না হওয়ায় পেশার বৈচিত্র্য নেই। জেলার ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থীই প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগেই ঝরে পড়ছে। দেশের সব জেলার মধ্যে সুনামগঞ্জ এতে চতুর্থ।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছেন বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. খলিলুর রহমান। তার মতে, বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ থেকে শিল্পায়নের দিকে যাচ্ছে। এতে কৃষি কমেছে। তবে শিল্পায়নেও পুরোপুরি অবস্থান তৈরি হয়নি। জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি শ্রেণী তৈরি হয়েছে, যারা স্বল্প সময়ে অনেক বেশি টাকার মালিক হয়েছে। ফলে ধনী ও দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি বলেন, খাদ্যের সংকট তৈরি হলে যত টাকাই থাকুক খাবার পাওয়া যাবে না। ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়েছে। ইউরোপিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আমরা বিদেশ থেকে খাদ্য কিনে চাহিদা পূরণ করতে পারব না। কৃষককে শ্রমের নিরাপত্তা, ন্যায্যমূল্য ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না দিলে ভবিষ্যতে বড় বিপর্যয় তৈরি হবে। কৃষককে ধীরে ধীরে আধুনিক করতে হবে। এতে খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি সবকিছুই সমানভাবে নিশ্চিত করা যাবে। ২০২০ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপে দেখা যায়, দরিদ্র পরিবারগুলো আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ ভাত, ডাল ও আলু কিনতে খরচ করে। চাল, ডাল কিংবা আলুর মধ্যে কিছু পুষ্টি দিয়ে দিতে পারলে অপুষ্টির সমস্যা কিছুটা কমে আসত।
খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার কারণে দেশে ছয় মাস থেকে দুই বছর বয়সী ৬৬ শতাংশ শিশু পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্য পায় না বলে সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)। মূলত খাদ্যনিরাপত্তার অভাব, পুষ্টি সম্পর্কে শিশুর বাবা-মায়ের জ্ঞান ও সচেতনতা না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। উপযোগী পরিপূরক খাবার না পাওয়ার তালিকায় শহরের বস্তি ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী এগিয়ে রয়েছে।
হাওর অঞ্চলের কৃষিজীবীদের অধিকার রক্ষায় গঠিত সংগঠন হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন বলছে, হাওরে অপরিকল্পিতভাবে আবাসন করা হচ্ছে। সরকারি বিলগুলো ভরাট করে ফেলায় হাওরের কৃষিজমিগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বছরে ৩ শতাংশ করে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। এতে খাদ্যের সংকট আরো সৃষ্টি হয়েছে। যেসব কৃষক বছরের বড় একটি সময় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা মাছ পাচ্ছেন না। ঘরে শুধু চাল থাকলেও অন্যান্য খাদ্য উপাদানের ঘাটতি তৈরি হয়। হাওর-বিল ভরাট হয়ে যাওয়ায় মাছ খাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সালেহীন চৌধুরী শুভ বণিক বার্তাকে বলেন, প্রতি বছর কার্তিক মাসে হাওর অঞ্চলে খাদ্যের ঘাটতি দেখা যায়। অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে কৃষকরা ফসল চাষ করলেও তাদের ঘরে খাদ্যের অভাব থাকে। আমন ধানের জন্য তারা অপেক্ষা করেন। তবে ওই সময়ে কৃষকদের অর্ধেক অর্ধাহারে-অনাহারে থাকে। চলতি বছরের বন্যায় ফসলের সঙ্গে সঙ্গে বেশির ভাগ বাসিন্দা বাড়িঘর হারিয়েছেন। অবস্থা এমন হয়েছে যে কেউ দিলে তবেই খাবার খায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাসের মাঝামাঝি থেকে গতকাল পর্যন্ত বন্যায় জেলার সব উপজেলা দুর্গত হয়েছে। আর জেলার ৮৮টি ইউনিয়নেরই বাসিন্দারা বন্যাকবলিত হয়েছে। সংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য জটিলতায় পড়েছে জেলার অনেক বাসিন্দা।
বন্যার আগেই ধান সংগ্রহ করা হয় বলে দাবি করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (সুনামগঞ্জ) উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বন্যার আগে প্রায় ৯৭ শতাংশ বোরো ধান সংগ্রহ করা হয়েছে। ক্ষতি হতে পারে মাত্র ৩ শতাংশ ফসলের। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিগুলো কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। সুনামগঞ্জের মূল ফসল হচ্ছে বোরো ধান। আমন ও আউশ ধানের সম্ভাবনা কম থাকে। না খেয়ে থাকে এমন কোনো পরিবার জেলায় নেই। যাদের জমি নেই তারা বন্যা চলাকালে একটু সমস্যায় পড়তে পারে। জেলায় প্রায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টন ফসল উদ্বৃত্ত রয়েছে।
বন্যা-পরবর্তী হাওর অঞ্চলের পরিবারগুলোর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা নিয়ে উইলি অনলাইন লাইব্রেরির সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের ৬২ শতাংশ পরিবার বন্যা-পরবর্তী সময়ে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অতিদরিদ্র, গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতি, পেশায় প্রাকৃতিক সম্পদ ও খাদ্য ক্রয়ের ওপর নির্ভরতাকে বন্যা-পরবর্তী খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় উল্লেখযোগ্য ঝুঁকির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
খাদ্য বিতরণ ও সামাজিক নিরাপত্তার বাইরে শুধু খাদ্য মজুদ করে থাকে খাদ্য অধিদপ্তর উল্লেখ করে সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নকীব সাদ সাইফুল ইসলাম জানান, বন্যার কারণে গুদাম থেকে সাড়ে চার হাজার টন বিভিন্ন খাদ্যশস্য সরবরাহ করা হয়েছে, যার মধ্যে ১ হাজার ৫০০ টনের মতো চাল রয়েছে। খাদ্য অধিদপ্তর বছরে পাঁচ মাস খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি পালন করে। যে সময়ে শ্রমজীবীদের কাজ থাকে না, সে সময়ে প্রায় ৯২ হাজার পরিবারকে খাদ্যসহায়তা দেয়া হয়।
সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ আইপিসি ক্রনিক ফুড ইনসিকিউরিটি রিপোর্ট’ শিরোনামের আইপিসির গবেষণাটিতে অর্থায়ন করেছে ইউএসএআইডি। এতে বাংলাদেশ সরকার এবং ৩১টি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সহযোগিতা করেছে। দশ বছরের পর্যবেক্ষণেও ওই প্রতিবেদনে আইপিসি বলেছে, দেশের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ মধ্যম ও গুরুতর মাত্রার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, যা মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ।
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বণিক বার্তার সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি আল আমিন)