দেশে গত এক মাসের বেশি সময় ধরে প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েছে। মূলত ওমিক্রনের কারণেই দৈনিক রোগী শনাক্তের সংখ্যা বাড়ছে। তাতে ডেল্টা ধরনের প্রাদুর্ভাবের সময়ের মতো সংকট সৃষ্টি না হলেও চাপ বাড়ছে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোয়। এর আগে বিভিন্ন সময়ে সক্রিয় করোনা রোগীর ৬০-৬৫ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে চিকিৎসা নিলেও বর্তমান সংক্রমণের সময় তা বেড়েছে। বর্তমানে সক্রিয় করোনা রোগীর ৯৮ শতাংশ সরকারি বা বেসরকারি কোনো ব্যবস্থাপনায়ই স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসছে না। তারা বাড়িতে নিজে নিজে অথবা চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করলেও সরকারের পর্যবেক্ষণের বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে তাদের মাধ্যমে করোনা রোগী বৃদ্ধি ও করোনা-পরবর্তী জটিলতা বৃদ্ধির শঙ্কা থেকে যাচ্ছে। তবে রোগীরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পর্যবেক্ষণে না থাকলেও টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে সেবা নিচ্ছে বলে দাবি করছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।
সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে সক্রিয় করোনা রোগী রয়েছে ১ লাখ ৮১ হাজার। এর মধ্যে সারা দেশে নির্ধারিত সরকারি ও বেসরকারি করোনা হাসপাতালে ৩ হাজার ২০০ রোগী ভর্তি রয়েছে। ভর্তি রোগীরা সাধারণ শয্যাসহ নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ও হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) ভর্তি রয়েছেন। ফলে বাকি ১ লাখ ৭৮ হাজার রোগী হাসপাতাল অথবা অন্য কোনো ধরনের চিকিৎসা কেন্দ্রের মাধ্যমে চিকিৎসা নিচ্ছে না। শুধু সক্রিয় রোগীর ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ হাসপাতালে এসেছে। ওমিক্রনে আক্রান্তদের মধ্যে সংকটাপন্ন রোগীর হার কম হলেও বয়স্ক এবং শিশুদের ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তির হার বেশি। যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে না তারা অপ্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা গ্রহণ করলেও সরকারের পর্যবেক্ষণে নেই। ফলে সঠিকভাবে চিকিৎসা পরিচর্যার ঘাটতি থেকে যাচ্ছে বলে মনে করেন রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, শুরুতে যেভাবে রোগীকে পর্যবেক্ষণে রাখা হতো পরে সেভাবে কার্যক্রম রাখতে পারেনি সরকার। একসময় রোগীর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পায়। এখন সরকারি ও বেসরকারিভাবে করোনা পরীক্ষা করা হয়। কেউ পজিটিভ হলে তার করোনা পরীক্ষার সনদ অনলাইনে দেয়া হয় বা সেলফোনে ক্ষুদে বার্তা দেয়া হয়। এরপর আর কোনো পর্যবেক্ষণ নেই। যাদের মধ্যে উপসর্গগুলো মারাত্মক হচ্ছে তারাই হাসপাতালে আসছে। বাকিরা বাড়িতে সেবা নিচ্ছে। প্রয়োজন মনে করলে টেলিমেডিসিনের সেবা নিচ্ছেন। অথবা ব্যক্তিগতভাবে কোনো চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে ওষুধ কিনে খাচ্ছেন। কিন্তু সরকারের পর্যবেক্ষণে রাখলে সঠিক সেবা দেয়ার পাশাপাশি সঠিক পরিসংখ্যানও করা যেত।
ওমিক্রনে মৃত্যু কম হবে এমনটি ভাবার অবকাশ নেই উল্লেখ করে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, রোগী বেশি হওয়ায় অনেক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে শুরু থেকেই রোগীদের সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার ছিল। যারা হাসপাতালে যাচ্ছে তারা চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে আর যারা হাসপাতালের বাইরে তারা চিকিৎসা পর্যবেক্ষণের বাইরেও থাকছে। ফলে করোনা মহামারীর বিভিন্ন সময় পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ওয়ার্ডভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে রোগীদের চিকিৎসা পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা প্রয়োজন। এতে সরকারের কিছু খরচ হলেও অনেক খরচ বেঁচে যাবে। জেলা হাসপাতাল, উপজেলা হাসপাতালকে শুধু অভ্যন্তরীণ চিকিৎসায় কাজে লাগিয়ে বসে থাকলে চলবে না। বাহ্যিক কার্যক্রমও বাড়াতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমেও পর্যবেক্ষণ করা যায়। করোনার সবচেয়ে বড় বিষয় হলো রোগী ব্যবস্থাপনা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ৯৮ শতাংশ করোনা রোগী হাসপাতালের বাইরে থাকলেও তারা পর্যবেক্ষণের বাইরে নয়। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে তাদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সাধারণত করোনায় আক্রান্তদের ২০ শতাংশের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়ে। বাকিরা বাড়িতেই চিকিৎসা নিতে পারবে। ওমিক্রনে হাসপাতালে ভর্তির হার কম। এর মধ্যে গত এক মাসে স্বাস্থ্য বাতায়ন (১৬২৬৩), ৩৩৩ এবং আইইডিসিআরের (১০৬৫৫) নম্বরে ফোন দিয়ে ৩ লাখ ৮৮ হাজারের বেশি করোনা রোগী চিকিৎসা নিয়েছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, ফোনে চিকিৎসা পরামর্শ দেয়ার জন্য যেসব কল সেন্টার সরকার চালু রেখেছে তাতে রোগীরা নিজ ইচ্ছায় ফোন করছে। এসব ফোনকলের অধিকাংশই কোনো না কোনো অভিযোগ দেয়ার জন্য বা অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসসহ নানা তথ্য জানার জন্য দেয়া হয়। গত এক মাসে স্বাস্থ্য বাতায়নে আগত ফোন কলের ৬০ শতাংশকে চিকিৎসকের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালের বাইরে রোগীদের পর্যবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারের চিন্তাভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ শুধু হাসপাতাল নিয়েই ব্যস্ত। যারা নিজ উদ্যোগে ফোন করে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলছে তারা কিছুটা চিকিৎসা পরামর্শ পাচ্ছে। তবে একবার ফোনে চিকিৎসা পরামর্শ দেয়ার পর তাদের অবস্থা কী হচ্ছে তা সরকার জানছে না।
করোনা রোগী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, চিকিৎসা শুধু হাসপাতালকেন্দ্রিক নয়। স্বাস্থ্যসেবা বিভিন্ন পর্যায়ে হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে এমন ব্যবস্থা ও পরিকল্পনা নেই। পরীক্ষার পর যাদের করোনা শনাক্ত হচ্ছে তাদের স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা যেত। প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে সচেতনতামূলক পরামর্শ দেয়া যেত। শুধু সঠিক চিকিৎসা ও পরামর্শের অভাবে জটিলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সব করোনা রোগীকে চিকিৎসা পর্যবেক্ষণের আওতায় আনতে পারলে দেশের করোনা পরিস্থিতির এত অবনতি হতো না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ওমিক্রনের সংক্রমণ ক্ষমতা দুই-তিন গুণ বেশি। তবে ডেল্টা বা আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর চেয়ে ওমিক্রনে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজনীয়তা ২০ ভাগ কম থাকবে।
দেশের সব পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালে করোনা রোগী চিকিৎসা ও পরামর্শের ব্যবস্থা রয়েছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন না তারা পর্যবেক্ষণের বাইরে থাকছে তা সঠিক নয়। সবাই কোনো না কোনোভাবে পর্যবেক্ষণের আওতায় আসছে। আমরা কার্যক্রম আরো বাড়ানোর চেষ্টা করছি।