অবকাঠামো ও শিক্ষক সংকট: শর্ত পূরণ না করেই চলছে গাজী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

অবকাঠামোগত ঘাটতি, শিক্ষক সংকট, পরীক্ষাগার-শ্রেণীকক্ষসহ অনেকগুলো শর্ত পূরণ না করেই চলছে খুলনার গাজী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। ৫০০ শয্যার কথা বললেও হাসপাতালে গিয়ে পরিদর্শক কমিটি পেয়েছে মাত্র ১৫০ শয্যা। আইন অনুযায়ী বেসরকারি এ চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের নেই নির্দিষ্ট পরিমাণ ফ্লোরস্পেসও। বিধি না মেনে ভবনের মধ্যেই পরিবার নিয়ে বাস করছেন কলেজ পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান। কলেজের শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গিয়েছে।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. একেএম আমিরুল মোরশেদ বণিক বার্তাকে বলেন, কোনো মেডিকেল কলেজ বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভবনে বাসভবন রাখার সুযোগ নেই। গাজী মেডিকেল কলেজে যেসব ঘটতি রয়েছে তা উল্লেখ করে আমরা প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়কে জমা দিয়েছি। সব মেডিকেল কলেজের ক্ষেত্রেই আমরা নিয়ম মেনে প্রতিবেদন প্রস্তুত করি। এরপর মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয়।

স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গাজী মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য প্রথম অনুমোদন পায় ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সে সময় ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের জন্য ৫০ জন শিক্ষার্থীকে ব্যাচেলর অব মেডিসিন অ্যান্ড ব্যাচেলর অব সার্জারি (এমবিবিএস) ডিগ্রিতে ভর্তি করা হয়। এরপর ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে ১০০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির। বর্তমানে প্রায় ৫৫০ শিক্ষার্থী রয়েছে কলেজটির।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ আইন-২০২২ কার্যকর করে সরকার। আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করার আগে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালা ২০১১ (সংশোধিত) অনুযায়ী পরিচালিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আইন কার্যকর হওয়ার আগেও নীতিমালা মানেনি গাজী মেডিকেল কলেজ। কলেজ ও হাসপাতাল ভবনের জন্য ১ লাখ ৩০ হাজার বর্গফুট ফ্লোরস্পেসের ঘাটতি রয়েছে। ১০০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে হাসপাতালে রোগীর জন্য ৫০০ শয্যা থাকার কথা থাকলেও আছে কেবল ১৫০টি। এর মধ্যেই নিয়মবহির্ভূতভাবে কলেজ ভবনে পরিবার নিয়ে বাস করছেন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ডা. গাজী মিজানুর রহমান।

সরজমিনে দেখা যায়, গাজী মেডিকেল কলেজ এবং কলেজের হাসপাতালটির অবস্থান খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গায়। পাশাপাশি সংযুক্ত দুটি ১০ তলা ভবনের একটিতে কলেজ ও অন্যটিতে হাসপাতালের কার্যক্রম চলমান। কলেজ ভবনের নয়তলায় চেয়ারম্যানের বাসভবন। ১০ তলায় কলেজের লেকচার থিয়েটার। পাশে সংযুক্ত হাসপাতাল ভবনের ৯ ও ১০ তলায় চেয়ারম্যানের বাসভবন ও কার্যালয় রয়েছে। দুই ভবন থেকেই চেয়ারম্যানের বাসভবনে প্রবেশের পথ রাখা হয়েছে। কলেজটির শুরুতে আটতলায় চেয়ারম্যানের বাসভবন থাকলেও ভবন ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের পর তা নয়তলায় নেয়া হয়েছে।

বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ আইন অনুযায়ী গঠিত কমিটি কলেজগুলোকে পরিদর্শন শেষে শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম অনুমোদনের সুপারিশ করে। সাধারণত প্রতি বছর পরিদর্শন করে কলেজের মূল্যায়ন প্রতিবেদন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে পাঠানো হয়। গাজী মেডিকেল কলেজের বিষয়ে সর্বশেষ ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর মন্ত্রণালয়কে পরিদর্শন প্রতিবেদন পাঠিয়েছে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তর। এরপর আরো একটি পরিদর্শন হলেও সে প্রতিবেদন প্রস্তুতের কাজ চলছে।

গত বছর অক্টোবরে প্রস্তুত করা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গাজী মেডিকেল কলেজে নীতিমালা (২০২২ সালে আইন কার্যকর করার আগে নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালনা করার বিধান রয়েছে) অনুযায়ী অন্তত ১০টি শর্ত পূরণে ঘাটতি রয়েছে। আইন অনুযায়ী, ৫০ জন শিক্ষার্থীর জন্য মেট্রোপলিটন এলাকায় এরই মধ্যে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বেসরকারি মেডিকেল কলেজের জন্য ন্যূনতম এক একর জমি থাকতে হবে। গাজী মেডিকেল কলেজে বর্তমানে শিক্ষাবর্ষে ১০০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। ফলে আইন অনুযায়ী জমির ঘাটতি রয়েছে। একইভাবে ৫০ জন শিক্ষার্থীর জন্য কলেজের একাডেমিক ও হাসপাতাল কার্যক্রমের জন্য এক লাখ করে দুই লাখ বর্গফুট ফ্লোরস্পেস থাকার কথা। আর ১০০ শিক্ষার্থীর জন্য থাকার কথা চার লাখ বর্গফুটের ফ্লোরস্পেস। কিন্তু এ কলেজে ১০০ শিক্ষার্থীর একাডেমিক কার্যক্রমের জন্য পৌনে ৮১ হাজার বর্গফুট ও হাসপাতালের কার্যক্রমের জন্য ৫০ হাজার বর্গফুট ফ্লোরস্পেসের ঘাটতি রয়েছে।

কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কলেজে প্রয়োজনীয় ল্যাব ও শ্রেণীকক্ষ নেই। শিক্ষকের ঘাটতি আছে। শিখন পদ্ধতির মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসক ও শিক্ষকের সঙ্গে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোতে রয়েছে সংকট। বিভিন্ন বিভাগে রোগীদের সংকট রয়েছে। হাসপাতালের মান ভালো হলে রোগীরা আসবে। আর তাতেই শিক্ষার্থীদের মান উন্নয়ন হবে।

১০০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৭০ শতাংশ বেড অকুপেন্সিসহ (রোগী ভর্তির হার) হাসপাতালে ৫০০ শয্যা থাকার কথা আইনে উল্লেখ রয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ হাসপাতালে ৫০০ শয্যা থাকার কথা বললেও পরিদর্শন কমিটি শয্যা পেয়েছে মাত্র ১৫০টি। এতে ঘাটতি রয়েছে ৩৫০ শয্যার। একই সঙ্গে এ কলেজের হাসপাতালে বেড অকুপেন্সি রয়েছে মাত্র ৪০ শতাংশ। নাম প্রকাশ না করে একাধিক স্থানীয় ব্যক্তি জানান, বিভিন্ন সময় চিকিৎসা অবহেলাসহ নানা কারণে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ অভিযান পরিচালনা করে এ কলেজের হাসপাতালে। বিভিন্ন অংকের অর্থদণ্ডও করা হয় নানা সময়ে। এ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার মূল্য অতিরিক্ত রাখারও অভিযোগ করেন তারা।

স্বাস্থ্যশিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে যেসব শর্ত মানতে হয়, তা মেনে বাংলাদেশে কলেজ খুলতে দেখা যায় না। মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অধিভুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) প্রয়োজনীয় আইন বা নীতিমালার বাস্তবায়ন দেখবে। এ তিন কর্তৃপক্ষ যদি আইন অনুযায়ী কাজ করে তাহলে কোনো মেডিকেল কলেজ ঘাটতি রেখে একাডেমিক ও হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। আইন না মেনে ইচ্ছামতো কলেজ পরিচালনা করলে সেখান থেকে চিকিৎসাবিদ্যায় ডিগ্রি অর্জনকারীরা ভালো চিকিৎসক হিসেবে সেবা প্রদানে ব্যর্থ হবেন।

ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের (ডব্লিউএফএমই) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, কোনো মেডিকেল কলেজ যদি আইন ও নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালিত না হয়ে ডিগ্রি প্রদান করে, সেখানে বাস্তবিক অর্থে শিক্ষার্থীরা নৈতিকভাবে প্রস্তুত (ইথিক্যাল প্র্যাকটিস) হতে পারবেন না। সাধারণত যারাই ওইসব মেডিকেল কলেজ থেকে ডিগ্রি নিয়ে চিকিৎসক হবেন, তাদের ওপর মানুষ আস্থা রাখবে না। সরকারের উচিত আইনের বাইরে গিয়ে যেসব মেডিকেল কলেজ পরিচালিত হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া। গাজী মেডিকেল কলেজের যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তাতে এ কলেজ যে ডিগ্রি শিক্ষার্থীদের দেবে, তার স্বীকৃতি প্রশ্নবোধক হবে।

কলেজের একাডেমিক ভবন ও হাসপাতালে বাসভবন থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন গাজী মেডিকেল কলেজের পরিচালনা পর্ষদ চেয়ারম্যান ডা. গাজী মিজানুর রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের কলেজ ও হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে বাসভবন রয়েছে। কলেজ ও হাসপাতালের যে পরিমাণ ফ্লোরস্পেসের ঘাটতি রয়েছে, তা পূরণে আমরা নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করছি। হাসপাতালে ৫০০টি শয্যা না থাকলেও স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের ১৫০ শয্যার তথ্য সঠিক নয়। কলেজ ও হাসপাতাল ক্যাম্পাসে আবাসিক মেডিকেল অফিসার থাকেন। কনসালট্যান্টরা থাকতে পারেন। কলেজ ও হাসপাতাল দেখাশোনার সুবিধার জন্য আমার বাসা রয়েছে ওই ভবনে। এতে কলেজ ও হাসপাতালের কোনো সমস্যা হয় না, বরং পরিচালনার জন্য সুবিধা হয়।

Source: Bonik Barta

Share the Post: