অর্থাভাবে মাঝপথে বন্ধ হচ্ছে কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস

দুটি কিডনি অকার্যকর হওয়ায় প্রায় দুই বছর নিয়মিত ডায়ালাইসিস সেবা নিয়েছেন চট্টগ্রামের পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব ইমরুল কায়েস। ডায়ালাইসিস ও আনুষঙ্গিক ব্যয় বাবদ প্রতি মাসে তার খরচ হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা করে। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্যও প্রয়োজনীয় অর্থ এবং দাতা না থাকায় কিডনি দেয়া যায়নি তাকে। চিকিৎসা ব্যয়ের জোগান দিতে গিয়ে সব হারিয়ে ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে নিয়মিত ডায়ালাইসিস বন্ধ হয়ে যায় তার। বছরখানেক আগে মৃত্যু হয় তার।

ইমরুল কায়েসের মতো দেশের কিডনি রোগীদের বড় একটি অংশ ডায়ালাইসিস শুরুর পর টাকার অভাবে মাঝপথেই তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। অকালে মৃত্যু হয় তাদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি প্রতিস্থাপন করলে কিডনি রোগে আক্রান্তদের জীবন বাঁচে। কিন্তু নিকটাত্মীয় ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে কিডনি নেয়ার বিষয়টি আইনসিদ্ধ নয়। এক্ষেত্রে রোগীর জীবন বাঁচানোর একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায় ডায়ালাইসিস। এ ডায়ালাইসিস মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেলে তা হয়ে ওঠে রোগীর অকাল মৃত্যুর কারণ।

কিডনি রোগীদের চূড়ান্ত অসুস্থতার সময়ে ডায়ালাইসিসের প্রভাব খুঁজে বের করতে সম্প্রতি এক গবেষণা চালান শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের নেফ্রোলজি বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক। এতে উঠে আসে, কিডনি রোগীদের অর্ধেকই তাদের অসুস্থতার শেষ পর্যায়ে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসেন। কয়েকটি ডায়ালাইসিস করানোর পর তা বন্ধ করে দেয় মোট রোগীর ৩৯ শতাংশ, যার সবচেয়ে বড় কারণ আর্থিক সংকট। এছাড়া পরিবহন সুবিধা ও পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতার অভাবের কারণেও অনেকের ডায়ালাইসিস বন্ধ হয়ে যায়। গবেষণায় পাওয়া ফলাফল সম্প্রতি বাংলাদেশ জার্নাল অব মেডিসিনে ‘আউটকামস অব ডায়ালাইসিস ইন লো ইনকাম কান্ট্রি—অ্যান এক্সপেরিয়েন্স ইন আ টারশিয়ারি কেয়ার সেন্টার অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক নিবন্ধে প্রকাশ হয়েছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, কিডনি রোগের উপসর্গ শুরুতে বোঝা যায় না। যখন কিডনি চরম মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখনই তা প্রকাশ পায়। সাধারণত প্রস্রাবে প্রদাহ, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, অতিমাত্রায় ব্যথানাশক ওষুধ প্রয়োগ ও খাদ্যাভ্যাসের কারণে কিডনি রোগ হয়ে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ রোগ বংশগত। তবে নিয়মিত পরীক্ষা করালে শুরুতেই কিডনির সমস্যা শনাক্ত করা সম্ভব।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের নেফ্রোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রতন দাস গুপ্তা এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, কিডনি রোগে যারা আক্রান্ত হন, তারা চিকিৎসার জন্য একদম শেষ পর্যায়ে হাসপাতালে আসেন। দুটি কিডনিই বিকল হয়ে পড়লে কিডনি প্রতিস্থাপনের বিকল্প নেই। যতদিন কিডনি প্রতিস্থাপন সম্ভব হয় না, ততদিন নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয়। এজন্য সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করানোর বিষয়টি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।

প্রসঙ্গত, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর দেহবর্জ্য শরীর থেকে বের করে দেয়ার জন্য ছাঁকনি হিসেবে কিডনি কাজ করে। কিডনি শরীরে প্রবাহিত সব রক্ত ছেঁকে দূষিত বর্জ্য পানির সঙ্গে মিশিয়ে মূত্র হিসেবে বের করে দেয়। কিডনি বিকল হলে এ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। কিডনির পরিবর্তে কৃত্রিম ছাঁকনি ব্যবহার করে দেহ থেকে রক্ত ছেঁকে বর্জ্য বের করার প্রক্রিয়াকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ডায়ালাইসিস বলা হয়। কিডনি প্রতিস্থাপনের আগ পর্যন্ত ডায়ালাইসিসের কোনো বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম।

কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস হয় এমন কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, ডায়ালাইসিসের জন্য সরকার থেকে কোনো ফি নির্ধারণ করা হয়নি। সরকারি হাসপাতালের ফি কিছুটা কম হলেও বেসরকারি হাসপাতালে তা কয়েক গুণ বেশি। প্রতি ডায়ালাইসিসের জন্য সরকারি হাসপাতালের ফি সাধারণত হাজার টাকার মধ্যে হলেও বেসরকারি হাসপাতালে তা অনেক বেশি। কোনো কোনো বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিসের ফি ৮ হাজার টাকা থেকে শুরু। পরিবহন ও অন্যান্য ব্যয় যুক্ত হয়ে এ খরচ দাঁড়ায় মোটা অংকে।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে কম খরচে ডায়ালাইসিস করা হলেও একজন কিডনি রোগীর মাসে ২০-৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গরিব রোগীরা ডায়ালাইসিসের আওতায় আসেন না। এর মূল কারণ হলো খরচ ও ডায়ালাইসিস সুবিধার অপ্রতুলতা।

ব্যয়বহুল হওয়ার পাশাপাশি রোগী বিদ্যমান আয়েও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে কিডনি রোগ। ডায়ালাইসিসের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর মাসিক আয়ও কমতে থাকে। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজের (সিএমওএসএইচএমসি) তিন বিশেষজ্ঞ পরিচালিত আরেক গবেষণায় আসে, ডায়ালাইসিস শুরুর আগে ৩২ শতাংশ রোগীর মাসিক আয় ৩০ হাজার টাকা থাকলেও তা পরে ১২ শতাংশে নেমে এসেছে। ডায়ালাইসিস শুরুর আগে ১৭ শতাংশের মাসিক আয় ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা থাকলেও ডায়ালাইসিস শুরুর পর তা নেমেছে ৯ শতাংশে। ‘ফাইন্যান্সিয়াল বার্ডেন অব ক্রনিক কিডনি ডিজিজ পেশেন্ট অন মেইনটেন্যান্স হেমোডায়ালাইসিস ইন চট্টগ্রাম’ শিরোনামে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ হয়েছে।

বারডেম ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) আরেক গবেষণায় উঠে এসেছে, শুধু খরচের ভয়ে ৩২ শতাংশ রোগী ডায়ালাইসিসের আওতায় আসতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে থাকে।

বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, অসংক্রামক রোগগুলোর মধ্যে কিডনি রোগ বর্তমানে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ২০ লাখের বেশি কিডনি রোগীর অকালে মৃত্যু হয় শুধু প্রয়োজনীয় সেবার অভাবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারের উচিত ডায়ালাইসিসের জন্য ভর্তুকি দেয়া। একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানকে সরকার সুবিধা দেয়। যেসব কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস প্রয়োজন, এমন ১ লাখ মানুষকে ভর্তুকির আওতায় আনা প্রয়োজন। আমরা দেখেছি, যারা নিয়মিত ডায়ালাইসিস করেন তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই তিন বছর পর আর্থিক সংকটে আর ডায়ালাইসিসে আসেন না। কিডনি বিকল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা মানুষের আয়ের উৎসও বিলুপ্ত হয়ে যায়।

এছাড়া দেশে বিদ্যমান মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন কিডনি রোগীবান্ধব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে নিকট আত্মীয়ের কাছ থেকে কিডনি নেয়ার কথা বলা হয়েছে। তাতে তেমন কোনো সফলতা আসছে না। কারণ সবার নিকটাত্মীয় কম এবং থাকলেও কিডনি নেয়ার উপযুক্ত নয়। কেউ যদি নিজ ইচ্ছায় কাউকে কিডনি দান করতে চায়, তাতে তাকে সুযোগ দেয়া উচিত। এটা নাগরিকের অধিকার। এ নিয়ে আমরা বহু আগে থেকেই আইনি লড়াই করছি।

কিডনি ডায়ালাইসিসের জন্য দেশে সরকারি সুবিধা অপ্রতুল। একই সঙ্গে সেবামূলক ডায়ালাইসিস কেন্দ্রের সংখ্যাও নগণ্য। জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মিজানুর রহমান জানান, তার হাসপাতালে ডায়ালাইসিস মেশিনের সংখ্যা বাড়িয়ে বর্তমানে ৬০টি করা হয়েছে। খুলনা, চট্টগ্রাম, বরিশালসহ বিভাগীয় শহরের টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতালে কিছু মেশিন থাকলেও তা খুবই কম। ডায়ালাইসিসের সুবিধা বাড়ানোর জন্য কাজ করছে সরকার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সব কিডনি রোগীদের চিকিৎসা দেয়া বর্তমান অবকাঠামোর মাধ্যমে সম্ভব হচ্ছে না। বড় বড় শহরে কিছু সুবিধা থাকলেও তা অপ্রতুল। একই সঙ্গে গ্রামীণ পর্যায়ে কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিসের জন্য লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়। এতে তারা স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হয়। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিসের সুবিধা বাড়াতে পারলে কিডনি রোগীদের দ্রুত মরণশীলতা রোধ করা যেত। অন্যদিকে বেসরকারি অবকাঠামো রোগীর ওপর খরচের বোঝা উঠিয়ে দিচ্ছে।

Source: Bonik Barta

Share the Post: