শহরের মতো জীবনাচারের পরিবর্তন এসেছে গ্রামাঞ্চলেও। ফাস্টফুডসহ অস্বাস্থ্যকর ও অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবারের বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে দ্রুতগতিতে। এর ধারাবাহিকতায় গ্রামাঞ্চলেও এখন খাদ্যাভ্যাসজনিত দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। বিশেষ করে গ্রামে গ্যাস্ট্রিক (ডিসপেপসিয়া) ও গ্যাস্ট্রিক আলসারের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। এরই মধ্যে তা শহরাঞ্চলকেও ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গত মাসে প্রকাশিত খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, গ্রামীণ বাসিন্দাদের মধ্যে প্রায় ২২ শতাংশ গ্যাস্ট্রিক আলসারে আক্রান্ত। আর শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে এ রোগের হার প্রায় ১৯ শতাংশ। এজন্য প্রধানত অস্বাস্থ্যকর ও অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রসারকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্তদের প্রায় ২১ শতাংশ গ্যাস্ট্রিক আলসারে ভুগছে। দেশের পুরুষ ও নারীদের মধ্যে এ হার যথাক্রমে ২১ দশমিক ৩৮ ও ২০ দশমিক ৩১ শতাংশ। শহরে এ রোগীর হার প্রায় ১৯ শতাংশ হলেও গ্রামে তা প্রায় ২২ শতাংশ। গ্রামে বসবাসকারী পুরুষদের মধ্যে গ্যাস্ট্রিক ২২ শতাংশ আর নারীদের মধ্যে ২১ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে শহরাঞ্চলে প্রায় ২০ শতাংশ পুরুষ ও ১৮ শতাংশ নারী গ্যাস্ট্রিক আলসারে ভুগছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব রোগ জীবনাচার ও খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সরাসরি জড়িত তার মধ্যে গ্যাস্ট্রিক আলসার অন্যতম। গত দুই দশকে গ্রামাঞ্চলে প্রক্রিয়াজাত খাবারের বড় বাজার তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে গ্যাস্ট্রিক আলসারের প্রাদুর্ভাবও।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে ডিসপেপসিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। গ্যাস্ট্রিক আলসারের রোগীও বেশি দেখা যায়। গ্রামাঞ্চলে এ রোগ বেশি। এর সঙ্গে খাদ্যের সংযোগ রয়েছে। গ্রামে এমন কিছু খাবার পাওয়া যায় যেগুলো স্বাস্থ্যসম্মত নয়। অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রসার গ্রামে বেড়েছে। শহরেও এসব খাবার রয়েছে। তবে নামহীন ও নিম্নমানের প্রতিষ্ঠানের অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রামে বেশি। সেখানকার বাসিন্দারা এখন সকালে দোকানের খাবারে অভ্যস্ত হয়েছে। নিম্নমান ও পোড়া তেলের খাবার গ্রহণ করছে। চালের মধ্যেও এখন ইউরিয়া দেয়া হয়, কোনো কোনো সবজি ও ফলে কীটনাশক, রাসায়নিক ও হরমোন প্রয়োগ করা হচ্ছে। নিরাপদ খাদ্যের অভাবে এ রোগ প্রভাবিত হচ্ছে। এটাকে জীবনাচারের রোগ বলা যায়।’
বাংলাদেশে অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রসার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জার্নাল উইলিতে উঠে এসেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘কমোনলি কনজিউমড প্রসেসড প্যাকেজড ফুডস ইন বাংলাদেশ আর আনহেলদি অ্যান্ড দেয়ার নিউট্রিয়েন্ট কনটেন্টস আর নট ইন কনফরমিটি উইথ দ্য লেবেল ডিক্লারেশন’ শিরোনামের ওই গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে প্রক্রিয়াজাত কৃষি ও খাদ্যপণ্যের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ। এটি বাংলাদেশে প্রক্রিয়াজাত খাবারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা প্রদর্শন করে। দ্রুত নগরায়ণ, ক্রমবর্ধমান আয় ও প্রাপ্যতা প্রক্রিয়াজাত খাবারের জন্য বর্ধিত চাহিদার প্রধান চালিকাশক্তি।
অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার বলতে বোঝায় সাধারণত খাওয়ার জন্য প্রস্তুত ও সুবিধাজনক প্যাকেজে যা বিক্রি করা হয়। এতে উচ্চ মাত্রার চিনি, স্যাচুরেটেড ফ্যাট, সোডিয়াম, অপর্যাপ্ত মাত্রার ভিটামিন ও খনিজের সঙ্গে উচ্চ ক্যালরির ঘনত্ব থাকে। প্রক্রিয়াজাত বা প্যাকেটজাত খাবারের মধ্যে মোটা দাগে স্ন্যাকস, রেডিমেড খাবার, প্রক্রিয়াজাত ফল ও শাকসবজি, দুগ্ধজাত পণ্য, চিনি-মিষ্টিযুক্ত পানীয় রয়েছে।
বাংলাদেশে গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে অতিপ্রক্রিয়াজত খাবার, ফাস্টফুডসহ (যা দ্রুত খাওয়া যায়) প্যাকেটজাত খাবারের বাজারের প্রসারের ওপর গত এক দশক আগে একটি গবেষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাজার জরিপ ও তথ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিলসন। মার্কেট রিসার্চ অন প্রসেসড ফুড ইন রুরাল বাংলাদেশ শিরোনামের ওই জরিপে উঠে এসেছিল, মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ গ্রামে বসবাস করছে। গ্রামের বাজারগুলোর মধ্যে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ৬৪ শতাংশই তরুণ, যাদের বয়স ৩০ বছরের কম। শহরের পরিবেশের মতো তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। ওই সময়ে দেশের মধ্যে প্রক্রিয়াজাত, অতিপ্রক্রিয়াজাত, প্যাকেটজাত ও তেলে ভাজা খাবারের গ্রাহক শহরের চেয়েও বেশি ছিল। শহরে সে সময় ভোক্তা ৪৮ শতাংশ থাকলেও গ্রামে ছিল ৫২ শতাংশ। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন দ্রুততার সঙ্গে হয়েছে।
দীর্ঘ সময় ধরে পুষ্টি, প্রক্রিয়াজাত, অতিপ্রক্রিয়াজাত খাদ্য নিয়ে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘গ্রামে অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রসার বেড়েছে। কিছুদিন আগে আমাদের একটি গবেষণা প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে আমরা শহর ও গ্রামে এসব খাদ্যের প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছি। পুষ্টির যে উপকরণগুলো রয়েছে তা সেসব খাবারে সঠিকভাবে নেই। কোনোটায় লবণ বেশি, আবার কোনোটায় চিনি বেশি। ফ্যাট ঠিক নেই, খনিজ ঠিক নেই। একই সঙ্গে ওই সব খাবারের মোড়কে উপাদানগুলোর যে পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছিল তার সঙ্গে খাবারে পাওয়া উপাদান সঠিক ছিল না। এসব খাবারে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। রেডি-টু-ইট খাবারগুলো সাধারণত শক্তি-ঘন ও উচ্চ পরিমাণে স্যাচুরেটেড ফ্যাট, সোডিয়াম এবং যুক্ত চিনি থাকে। অঞ্চল, ঋতু ও বয়সভেদে এ খাবারের ব্যবহারের ধরন পরিবর্তিত হয়।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আনওয়ারুল কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখন গ্রাম আর শহর বলতে আলাদা কিছু নেই। নগরায়ণের পরিসর বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপরিকল্পিত নগরায়ণ হয়েছে। মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচারের পরিবর্তন হয়েছে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এখন সকালের নাশতায় অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার খাচ্ছে। সঠিকভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা (হাইজিন) মানা হচ্ছে না। পেটের পীড়া, হজমে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। সে তুলনায় দেখা যায় শহরের মানুষ গ্রামের বাসিন্দাদের চেয়ে সচেতন বেশি। শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে তারা চিকিৎসকের কাছে আসছেন। গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে সেই সচেতনতা বা তাগিদ তৈরি হয়নি। গ্রামের মানুষ জীবনাচারের পরিবর্তন মেনে নিয়েছে ঠিকই কিন্তু স্বাস্থ্যসম্মত জীবনাচারে ঘাটতি রয়েছে। সেখানের জীবনও এখন জটিল হয়ে পড়েছে। মানসিক জটিলতা, অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচার শহর ও গ্রামে এখন প্রায় এক। গ্যাস্ট্রিক আলসার প্রমাণ করতে হলে এন্ডোসকপি করতে হবে। গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্টরা ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা শেষে আলসার শনাক্ত করবেন। লক্ষণ দেখে বা পরীক্ষা না করে আলসার হয়েছে সে উপসংহারে যাওয়া যাবে না।’
গ্যাস্ট্রিক আলসার বলতে যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা (এনএইচএস) বলছে, (গ্যাস্ট্রিক আলসার বা পেটের আলসার) এমন ক্ষত যা পাকস্থলীর আস্তরণে বিকশিত হয়। পেটের বাইরে অন্ত্রের অংশে আলসারও হতে পারে, যাকে ডুওডেনাল আলসার বলা হয়। পেটের আলসার ও ডুওডেনাল আলসার একই উপসর্গ সৃষ্টি করে এবং উভয়ের চিকিৎসা একই। পাকস্থলীর অ্যাসিড থেকে পাকস্থলীর আস্তরণকে রক্ষা করে এমন স্তরের ক্ষতি হলেই পেটের আলসার হয়। হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি (এইচ পাইলোরি) ব্যাকটেরিয়া আলসার সৃষ্টির জন্য দায়ী। অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি ওষুধ (এনএসএআইডিএস) যেমন আইবুপ্রোফেন বা অ্যাসপিরিন দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চমাত্রায় গ্রহণ করলে আলসার সৃষ্টি হতে পারে। মানসিক চাপ অথবা কিছু খাবার পেটের আলসারের কারণ হতে পারে। পেটের আলসার যে কাউকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে এ জটিলতা বেশি দেখা যায়। নারীদের তুলনায় পুরুষদের আক্রান্তের ইতিহাস বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাস্ট্রিক আলসার শনাক্ত করতে হলে এন্ডোসকপি করতে হবে। চিকিৎসক শনাক্ত করবেন। গ্রামের মানুষের মধ্যে গ্যাস্ট্রিক আলসার নিয়ে সঠিক ধারণা কম। গ্যাস্ট্রিক ও গ্যাস্ট্রিক আলসার এক নয়। এটা ক্লিনিক্যালি প্রমাণিত হতে হবে। গ্যাস্ট্রিক ও গ্যাস্ট্রিক আলসার জীবনাচারের কারণে প্রভাবিত হয়। খাদ্যাভ্যাস, অস্বাস্থ্যকর খাবার এর বড় প্রভাবক। প্রক্রিয়াজাত খাবারের ভোক্তা বেড়েছে। বিষয়টি নিয়ে গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি সোসাইটির সঙ্গে আমরা কাজ করছি।’