কয়েক মাস আগে থেকেই শীতে করোনার সংক্রমণ বাড়ার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সংক্রমণের দ্বিতীয় পর্যায় মোকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতির কথা জানিয়ে আসছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। বাস্তবতা হচ্ছে, করোনাক্রান্ত রোগী বাড়ায় এখন সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলো। খালি নেই আইসিও সিট। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিত্রও প্রায় একই রকম।
গত নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে দেশে প্রায় প্রতিদিন দুই হাজারের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। একই সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়েছে। অক্টোবরের চেয়ে নভেম্বরে করোনা রোগীর সংখ্যা ১৩ হাজারের বেশি বেড়েছে। চলতি মাসে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় এক লাখে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রোগীর সংখ্যা বাড়লেও চলতি মাসে করোনা রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যা কমানো হয়েছে। অক্টোবরের চেয়ে ডিসেম্বরে রাজধানীর নয়টি সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বেডের সংখ্যা কমেছে। এতে করোনায় ভুক্তভোগীরা জরুরি ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, রাজধানীতে নয়টি করে ১৮টি সরকারি ও বেসরকারি এবং একটি স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতাল নিয়ে মোট ১৯টি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। গত ১৬ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীতে ২১টি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য শয্যা সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ৩৭টি। এক মাস পর ১৬ সেপ্টেম্বর এ সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৬ হাজার ১০৭টিতে। দুটি কমিয়ে ১৯টি হাসপাতালে ১৬ অক্টোবর শয্যা সংখ্যা ৩ হাজার ৫১৯ রাখা হলেও ৮ ডিসেম্বর তা ৩ হাজার ৪০৪টিতে ঠেকেছে। এ সময়ের মধ্যে দুটি আইসিইউ বাড়িয়ে ৩১৬টি করা হলেও কমানো হয়েছে সরকারি হাসপাতালের আইসিইউর সংখ্যা। অক্টোবরে নয়টি সরকারি ও একটি স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে ১০১টি আইসিইউ থাকলেও গতকাল পর্যন্ত তা ৯৭টিতে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে দুটি সরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য কোনো আইসিইউ নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অ্যান্ড অপারেশন সেন্টার ও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সূত্রে জানা যায়, গতকাল রাজধানীতে নির্ধারিত নয়টি সরকারি হাসপাতালের মধ্যে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে কোনো আইসিইউ খালি ছিল না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৪টির মধ্যে ২২টি, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ১৫টির মধ্যে ১১টি ও শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে ১৬টির মধ্যে নয়টিতে করোনার জটিল রোগীরা ভর্তি রয়েছেন। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬টি আইসিইউর সবগুলো পূর্ণ ছিল। সরকারি নয়টি হাসপাতালের মধ্যে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য কোনো আইসিইউ নেই।
সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের করোনা ইউনিটের আইসিইউতে কর্তব্যরত এক নার্স নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আইসিইউতে শয্যা পেতে হলে রীতিমতো তদবির প্রয়োজন হয়। অনেকে আইসিইউ পায়ও না।’
এদিকে নয়টি বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে ইবনে সিনা ও বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে কোনো আইসিইউ খালি নেই। অন্যান্য হাসপাতালের মধ্যে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০টির মধ্যে নয়টি, আসগর আলী হাসপাতালে ৩১টির মধ্যে ২৬টি, স্কয়ার হাসপাতালে ২৫টির মধ্যে ১৮টি, ইউনাইটেড হাসপাতালে ২২টির মধ্যে ১৪টি, এভার কেয়ার হাসপাতালে ২০টির মধ্যে ১৯টি, ইমপালস হাসপাতালে ৫৬টির মধ্যে ২১টি, এ এম জেড হাসপাতালে ২১টির মধ্যে ১৯টিতে জটিল রোগীরা ভর্তি রয়েছেন।
অন্য হাসপাতাল থেকে ফেরত আসাদের আইসিইউ সেবা দেয়া যাচ্ছে না বলে জানান ইবনে সিনা হাসপাতালের কর্মকর্তা মুহিবুল মুহিব। তিনি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে যেসব রোগী ভর্তি থাকেন তারাই আইসিইউ পাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ থাকেন। সেখানেই অন্য হাসপাতাল থেকে পাঠানো রোগীকে দেওয়া যাবে কী করে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গতকাল নতুন করে ২ হাজার ২০২ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ২ হাজার ৯৪ জন রাজধানীর হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে কভিড-১৯ আক্রান্তদের জন্য ২৭৫টি শয্যা সংরক্ষিত থাকলেও হাসপাতালটিতে ৩১০ জন করোনা রোগী ভর্তি রয়েছেন। ঢাকা মহানগরীর সরকারি এ নয়টি হাসপাতালের ২ হাজার ১৭৩টি শয্যার মধ্যে ১ হাজার ৫২৪ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বাইরে সারা দেশে ৮ হাজার ১১টি শয্যা করোনা রোগীদের জন্য সংরক্ষিত থাকলে তাতে ভর্তি রয়েছেন মাত্র ১০৮ জন। ২৬২টি আইসিইউর মধ্যে ১১০টি আইসিইউতে রোগীর ভর্তি ছিলেন।
গত ১৬ অক্টোবর রোগীদের সেবায় সারা দেশে আইসিইউ ছিল ৫৬৪টি, যা গতকাল পর্যন্ত ৫৭৮টিতে দাঁড়িয়েছে। যার মধ্যে শুধু রাজধানীতেই ৩১৬টি। করোনার প্রথম সংক্রমণের সময়ে ভেন্টিলেটরের সংকট দেখা দিলেও আগের চেয়ে বর্তমানে ভেন্টিলেটরের সংখ্যা বাড়েনি। সারা দেশে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে ৬৫৯টি, অক্সিজেন কনসেনট্রেটের সংখ্যা রয়েছে ৫২৯টি, অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংখ্যা ১৪ হাজার ৩৭০টি। সেন্ট্রাল অক্সিজেনের সংযোগ এখনো সব জেলা হাসপাতালে পৌঁছেনি।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস বাংলাদেশে দ্বিতীয় পর্যায়ে মারাত্মকভাবে সংক্রমণ ঘটাতে পারে এমন আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সেপ্টেম্বরে যথাযথ প্রস্তুতি নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে সে নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়নি বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও করোনা প্রতিরোধে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। রাজধানীর বাইরে রোগীর চাপ কম থাকলেও তা দ্রুতই বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এ ভাইরোলজিস্ট।
তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জেলা পর্যায়ের আইসিইউর সংখ্যা বাড়ালে এমন হতো না। ঢাকায় এত রোগীর সংখ্যা তা নিশ্চয়ই বাইরে থেকে আসা। এটা নিয়ে বার বার কথা বললেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপের দেখা নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শুধু মুখেই প্রস্তুতির বুলি ছড়াবে বাস্তবে তারা কিছুই করছে না।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সংকট আছে তা বলা যায় না। দেশের অন্যান্য স্থান থেকে মানুষ রাজধানীতে এসে ভিড় করায় মূলত ঢাকায় এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। লোকবলের সংকটের কারণে আবার অনেক যন্ত্রাংশ চালানো যায় না। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’