আট বছরে ১৫ অগ্নিনির্বাপণ কর্মী নিহত ও আহত ১৭৪: অবসরের পরও কর্মজীবনে পাওয়া আঘাত ভোগায় সবচেয়ে বেশি

বঙ্গবাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছিল ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিট। পানি সংকটের কারণে বেগ পেতে হয় অগ্নিনির্বাপক দলকে। পাশের গুরুত্বপূর্ণ ভবনে যেন আগুনের আঁচ না লাগে সেজন্যও তত্পর ছিলেন তারা। এমনই একটি দলে কাজ করছিলেন রাজধানীর সূত্রাপুর ফায়ার স্টেশন অফিসার সঞ্জয় খান। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ভবনে ছিল তার দলটি। তবে বাতাসে ভেসে আসা ধোঁয়া ও আগুনের আঁচে একপর্যায়ে চেতনা হারান সঞ্জয়। তাকে নেয়া হয় কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে। গত মঙ্গলবার বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডে সঞ্জয়সহ ১০ জন অগ্নিনির্বাপক কর্মী নানাভাবে আহত হয়েছেন। তাদের সবাইকে ভর্তি করতে হয় রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে।

সঞ্জয় বণিক বার্তাকে জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে ও পুলিশ ভবনকে বাঁচাতে কাজ করছিল তার ইউনিট। এ সময় বাতাস থাকায় ধোঁয়ার কারণে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আগুনের আঁচ নাসারন্র্লে প্রবেশ করে। চেতনা হারান তিনি। এরপর তাকে উদ্ধার করে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। সেখান থেকে ছাড়পত্র পেয়ে কর্মস্থলে ফিরলেও বড় শ্বাস নিতে কষ্ট হয় তার।

বিভিন্ন সময় অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা (ফায়ার ফাইটার) গুরুতর আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন অনেকে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত আট বছরে সারা দেশে ঘটা অগ্নিকাণ্ডসহ সব ধরনের দুর্ঘটনায় সাড়া দিতে গিয়ে নিহত হয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের ১৫ কর্মী। আর এ সময় ১৭৪ জন হয়েছেন গুরুতর আহত। আহতদের মধ্যে শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ, মাংসপেশির ব্যথা, ব্যাকপেইন, মাথায় আঘাত ও শরীরের অন্যান্য অংশে আঘাত পেয়েছেন বেশি। কোনো কোনো কর্মী মানসিকভাবে বিষণ্ন ও উদ্বেগের মধ্যে পড়েছেন। সহকর্মীর মৃত্যু ও আহত হওয়ার ঘটনার সাক্ষী হয়ে কেউ কেউ আবার ট্রমার (মানসিক আঘাত) মধ্যে জীবনযাপন করছেন।

গত মঙ্গলবার ভোর ৬টার পর রাজধানীর বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ৬ ঘণ্টা লেগে যায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে। এতে পাঁচ হাজার ব্যবসায়ীর দোকান পুড়ে ছাই হয়েছে। কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি বঙ্গবাজার মার্কেটের ২ হাজার ৩৭০টি দোকান, মহানগর শপিং কমপ্লেক্স, আদর্শ মার্কেট ও গুলিস্তান মার্কেট পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়। ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, র্যাব, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশসহ (বিজিবি) পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়ার মাত্র ২ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছে তারা। তবে বাতাসের বেগ বেশি থাকায় এবং দোকানের ঘনত্বের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লেগে যায়। বঙ্গবাজারের ঘটনায় আহত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা হলেন উপপরিচালক বাবুল চক্রবর্তী, ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর মো. নুরুজ্জামান, মো. দিদারুল ইসলাম, মো. আল মাসুদ, স্টেশন অফিসার মো. সঞ্জয় খান, ফায়ার ফাইটার মো. মেহেদী হাসান, রবিউল ইসলাম অন্তর, মো. আতিকুর ইসলাম, মো. আনারুল ইসলাম ও চালক মো. ইমন আহমেদ। আহত এসব কর্মীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ও কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসা শেষে বাড়িতে ফিরেছেন তারা।

গত পাঁচ বছরে দুই শতাধিক অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে সামনে থেকে কাজ করেছেন স্টেশন অফিসার মো. সঞ্জয় খান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যখন দেখি অগ্নিকাণ্ডের কারণে রাষ্ট্রের সম্পদ নষ্ট হচ্ছে, কারো ব্যক্তিগত-বাণিজ্যিক সম্পদ নষ্ট হচ্ছে, কেউ মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়ছেন তখন নিজের কথা স্মরণে থাকে না। আমরা তখন পরিবারের কথাও ভুলে যাই। জীবনকে তুচ্ছ করে আমরা কাজ করি। তবে এ সময় যখন দেখি কোনো সহকর্মী বা কোনো সিভিলিয়ান আহত বা নিহত হয়েছেন তখন খুবই অসহায় লাগে। মানুষের বাঁচার আকুতি আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়।’

এর আগে গত বছরের জুনে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোয় আগুন নেভাতে গিয়ে বিস্ফোরণের ফলে নিহত হন নয়জন ফায়ার ফাইটার। আগুন নেভাতে নিকটস্থ কুমিরা ফায়ার স্টেশন ও সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশন থেকে দুটি দল দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে। ওই দুটি দলের ২৬ সদস্যের সবাই হতাহত হয়েছেন। ওইদিন নয়জন নিহত, তিনজন নিখোঁজ ও ১৪ জন অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। এ বছর সারা দেশে ১৩ জন ফায়ার ফাইটার নিহত হয়েছেন। আর গুরুতর আহত হয়েছেন ২৯ কর্মী।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনতে নিহত হয়েছেন ১৫ জন। এর মধ্যে ২০১৯ ও ২০২১ সালে একজন করে এবং সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছেন ২০২২ সালে, ১৩ জন। এ আট বছরে ১৭৪ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৮ জন আহত হয়েছেন ২০১৫ সালে।

সম্প্রতি বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ড ও আগের বিভিন্ন সময়ের অগ্নিকাণ্ডে যারা আহত হয়েছেন তাদের বেশির ভাগই ধোঁয়ার কারণে শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণে আহত হয়েছেন। এরপর অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন অনেকে। কেউ মাথায় ব্যথা পেয়েছেন। মূলত আগুন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাতাস বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, আগুন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাতাসের গতিপথ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগুনে দগ্ধ হওয়া ফায়ার ফাইটারের বেশির ভাগই বাতাসের গতিপথের কারণে আহত হয়েছেন। সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে ধোঁয়া। কোনো ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তা নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে ধোঁয়ার কারণে অসুস্থ হয়েছেন কর্মীরা। ধোঁয়া দ্রুততার সঙ্গে শ্বসনতন্ত্রের মাধ্যমে ফুসফুসে গিয়ে আক্রমণ করে। যারা আহত হয়েছেন তারা চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন। তবে অবসরের পর বিশেষ করে ষাটোর্ধ্বদের মধ্যে এসব সমস্যা বেড়ে দেখা গেছে। যারা কর্মজীবনে শ্বসনতন্ত্রে ধোঁয়ার ফলে অসুস্থ হয়েছেন, অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন, মাথায় আঘাত পেয়েছেন তাদের অসুস্থতার মাত্রা নির্দিষ্ট বয়স পর বেড়েছে। কেউ কেউ মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিন পার করছেন।

সম্প্রতি অবসরে গেছেন ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের এক কর্মকর্তা। তিনি জানান, চাকরিতে থাকা অবস্থায় ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার দুর্ঘটনায় উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছেন। এসব অভিযানের মধ্যে রানা প্লাজার উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়ার সময় দেয়াল ভেঙে পড়ে বাম পায়ে আঘাত পেয়েছিলেন। এরপর চার বছর চাকরি করেছেন। এখন তিনি অবসরে। মাঝে মধ্যেই বাম পায়ে সেই ব্যথা অনুভব করেন। এমন ব্যথা শুধু তিনিই নন, বয়ে বেড়াচ্ছেন আহত ১৭৪ অগ্নিযোদ্ধা।

ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের চিকিৎসাসেবার বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় সংস্থাটির মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিনের কার্যালয়ে। পরে তার পক্ষে মিডিয়া সেলের প্রধান শাজাহান সিকদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগুনসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনার উদ্ধার অভিযানে সাড়া দিতে গিয়ে প্রায়ই আঘাতপ্রাপ্ত হন কর্মীরা। এর মধ্যে যাদের অবস্থা গুরুতর তাদের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ), ঢাকা মেডিকেল থেকে শুরু করে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয়ও ফায়ার সার্ভিসকে দ্রুত সেবা দেয়।’ অবসর-পরবর্তী চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনো ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের জন্য অবসর-পরবর্তী কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফায়ার ফাইটারদের সক্ষমতা বাড়াতে আধুনিক যন্ত্রপাতির সমন্বয় করতে হবে। তাদের শুধু উন্নত প্রশিক্ষণ দিলেই হবে না। তারা যেন প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পায় তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বরাদ্দ দিতে হবে যন্ত্রপাতির জন্য। এতে তাদের আহত ও নিহতের সংখ্যা কমে আসবে। যদি আধুনিক যন্ত্র না থাকে তাহলে ঘটনাস্থলে গিয়ে তারা অসহায় হয়ে পড়েন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগুন নিয়ন্ত্রণসহ যেকোনো দুর্যোগে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা কাজ করছেন বিশেষ বাহিনী হিসেবে। যেকোনো পেশায় রিস্ক ও বেনিফিট (ঝুঁকি ও সুবিধা) থাকবে। তাদের ঝুঁকি বেশি থাকবে। তারা কী ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারেন এবং তাদের জন্য কী স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রাখা যায় তা ভেবে রাখতে হবে। যেন দ্রুত সাড়া দেয়া যায়। ধোঁয়া যেন যথাযথ ফিল্টার করা যায় এমন পোশাক দিতে হবে। আগুন, ধোঁয়া, পানি বা অন্য কোনোভাবে তারা যেন আহত না হন এজন্য যা যা করণীয় তা করতে হবে। কেননা এসব ক্ষেত্রে আহত হলে তা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির কারণ হয়। শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও কমে যায়।

চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ফায়ার ফাইটারদের জন্য বার্ন, ক্রিটিক্যাল কেয়ারের ক্ষেত্রে রেফারেল সিস্টেম (সংকটাপন্ন অবস্থায় দ্রুত হস্তান্তর) রাখতে হবে। যখন কোনো দল আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বা কোনো উদ্ধারকাজে যাবে তখন তাদের সঙ্গে পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে যেন একটি চিকিৎসাসেবার দল থাকে। যারা দ্রুত সাড়া দিয়ে চিকিৎসা দিতে পারবে। তারা যেন রেফার করতে পারে এজন্য যানবাহনের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। একই সঙ্গে যে এলাকায় ঘটনা ঘটছে সেখানকার স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও প্রস্তুতি নিতে হবে। ফায়ার ফাইটারদের জন্য বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বীমার বিষয়টিও খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। তারা যেন বীরত্বের পুরস্কার পান তা দেখতে হবে। অবসরকালে তাদের চিকিৎসা ও দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক জটিলতার সময় সরকারের সহযোগিতা দিতে হবে।’

Source: Bonik Barta

Share the Post: