ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ: খাদ্যপণ্যের বাড়তি দাম পুষ্টি ঘাটতি বাড়াচ্ছে

ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ বৈশ্বিক খাদ্য, জ্বালানি ও সারের দামে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে। রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা এ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, খাদ্যনিরাপত্তা ও দারিদ্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন এসব দেশের উন্নয়ন সহযোগীরা। এ অবস্থায় বাংলাদেশেও খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টিকর খাদ্যের সমতা নষ্টের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে গ্রামীণ গৃহস্থালিগুলো খাদ্যের জন্য তাদের খরচ কমিয়ে ফেলছে। এতে বৈচিত্র্যপূর্ণ পুষ্টিকর খাদ্য জোগানের ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা তৈরির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) এক গবেষণায় এসব বিষয় উঠে এসেছে।

‘বাংলাদেশ: ইমপ্যাক্টস অব দি ইউক্রেন অ্যান্ড গ্লোবাল ক্রাইসিস অন পভার্টি অ্যান্ড ফুড সিকিউরিটি’ শিরোনামের ওই গবেষণায় বৈশ্বিক খাদ্য, তেল ও সারের দামের ভারসাম্যহীনতা তুলে ধরা হয়েছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশে শস্য উৎপাদন, শহুরে ও গ্রামীণ পরিবারগুলোর মধ্যে পুষ্টিকর খাদ্যের সম্ভাব্য সংকটের কথা বলা হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিকভাবে শস্য ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের শহর ও গ্রামের পরিবারগুলোর দৈনন্দিন খাদ্য জোগানে টান পড়েছে উল্লেখ করে গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ৩ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে। মূলত খাদ্য, জ্বালানি ও সারের বৈশ্বিক দামের ভারসাম্যহীনতার কারণে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

গবেষণায় বলা হয়, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে গৃহস্থালিগুলো তাদের দৈনন্দিন খাদ্য জোগানে আমিষ, ভিটামিন, খনিজসহ মানবদেহের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় ছয়টি উপাদান গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে। দামের কারণে ন্যূনতম পরিমাণ সবজি, ফল, দুগ্ধজাত খাবার ও আমিষজাতীয় খাবার অনেকই পরিবারই জোগাড় করতে পারছে না। বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য হলো ভাত ও রুটি। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বেড়েছে এ দুই খাদ্যের মূল উপাদান চাল ও গমের দাম। বিশ্ববাজারে ভুট্টা ও গমের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অন্যান্য খাদ্যশস্যের দামও বাড়ছে। মানুষ পরিবারে খাবারের পেছনে যে ব্যয় হয় সেটি কাটছাঁট করছে বা কমিয়ে আনছে। ফলে পুষ্টিকর খাবারের কাঠামোয় পরিবর্তন আসছে। দেশের অনেক পরিবার পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রা অনুযায়ী শাকসবজি, ফলমূল, দুগ্ধজাত খাবার, মাংস ও মাছ গ্রহণের মাত্রা আগের চেয়ে অনেক কমিয়ে দিয়েছে।

বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে উৎপাদন ও আমদানির জোগানে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হওয়ায় তার প্রভাব পড়েছে দেশের স্থানীয় বাজারে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষ ন্যূনতম একটি অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার জ্বালানি ও সারের মূল্যবৃদ্ধিতে এসবের ব্যবহার কমে যাওয়ায় প্রায় অর্ধকোটি মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে অতিরিক্ত একটি খাদ্য গ্রহণ থেকে।

বাড়তি এ দামের কারণে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছে গ্রামের পরিবারগুলোর সদস্যরা। প্রান্তিক পর্যায়ের দুই কোটির বেশি মানুষ একটি অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শহরাঞ্চলে এ সংখ্যা ৭৬ লাখের মতো।

গবেষণায় বলা হয়েছে, গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্ববাজারে পাম অয়েল ও গমের দাম যথাক্রমে ৫৬ ও ১০০ শতাংশ বেড়েছে। একই সঙ্গে অপরিশোধিত তেলের দাম, সার ও প্রাকৃতিক গ্যাসের দামের বেড়েছে।

বাংলাদেশে গমের চাহিদার অর্ধেকের বেশি আমদানি করা হয়। ফলে বিশ্ববাজারের দামের ওপর আমদানি মূল্য নির্ভর করে। দাম বাড়লে আমদানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশের বাজারে স্বাভাবিকভাবেই দাম বেড়ে যায়। সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও এখনো দেশের বাজারে চাল ও গমের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এ দাম সরাসরি প্রভাব ফেলে ভোক্তার চাহিদার ওপর।

অন্যদিকে দেশের বেশির ভাগ খাদ্যশস্য উৎপাদন সারের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে ভুট্টা উৎপাদনের ৮৫ শতাংশ, ধান ও গমের জন্য ৯৫ শতাংশ করে, ডাল ৪৫, আইরিশ আলু ও তৈলবীজ উৎপাদনে ৭০ শতাংশ করে, শাকসবজি উৎপাদনে ৪৫, আখ উৎপাদনে ৯৫, বাদাম উৎপাদনে ৩৫, ফল উৎপাদনে ২৫ ও চা উৎপাদনে ৯০ শতাংশ সার ব্যবহার হয়। সারের দামের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতির কারণে কৃষক সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে বেশি হিসাবি হয়ে উঠছেন উল্লেখ করে গবেষণায় বলা হয়, আফ্রিকা ও এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের কৃষক বেশি সার ব্যবহার করেন। সারের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণে সার ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছেন তারা। ফলে উৎপাদন কম হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে শস্যের দাম।

যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বেই বিভিন্ন পণ্যে দামের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক মহাপরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, গত ফেব্রুয়ারি থেকে দ্রব্যের দাম বাড়ছে। আমাদের চালের চাহিদার ৬০ শতাংশ আসে বোরো ধান থেকে। সেটা মাঠ থেকে উঠে যাওয়ার পরও দাম সমানে বাড়ছে। এ সমস্যার মধ্যে আবার ইউক্রেন যুদ্ধ সংকটকে আরো তীব্র করেছে। চালের দাম বেড়ে গেলে মানুষ ভোগের পরিমাণ কমিয়ে দেবে। এতে পুষ্টির সমস্যা দেখা দেবে। এ সংকট থেকে উত্তরণ সহজ নয়। সম্প্রতি বেশকিছু প্রতিষ্ঠানকে শুল্কছাড়ে চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। এতে চালের দাম কমবে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। মূল্যবৃদ্ধির ফলে যেসব দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ে প্রভাব পড়েছে তাদের সহযোগিতা করতে হবে। একই সঙ্গে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। মোট কথা কোনো না কোনোভাবে তাদের সহযোগিতা করতে হবে।

প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় মোট ছয় ধরনের খাবার রাখার পরামর্শ দেন পুষ্টিবিদরা। দৈনিক গড়ে একজন মানুষের ২ হাজার ১০০ কিলোক্যালরি খাদ্যের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে আমিষজাতীয় খাবার যেমন—মাছ, মাংস, ডিম, ডাল ১০-১২ শতাংশ থাকতে হয়। ভাত ও রুটি বা শর্করাজাতীয় খাবার থাকতে হবে ৬০-৭০ শতাংশ। আর বাকি ২০-২৫ শতাংশ তেলজাতীয় খাবার থেকে আসতে হয়। প্রতিদিন ভিটামিন ও খনিজ যেমন—শাকসবজি, ফলমূল খেতে হয়। শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণের জন্য দুধ খেতে হয়। পুষ্টিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে জনসংখ্যা অনুযায়ী দুধের অভাব রয়েছে। দুধের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। আবার ক্রয়ক্ষমতার পার্থক্যের কারণে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ সব পণ্য সমানভাবে কিনতেও পারে না।

বিশ্বে তেল ও গমের বড় একটি অংশ সরবরাহ করত রাশিয়া। তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে সরবরাহ কমেছে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম আকতারুজ্জামান বলেন, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে খাদ্যশস্যের দাম বাড়ছে। কিন্তু মানুষের আয় বাড়েনি। সর্বশেষ মহামারীর প্রভাবে উল্টো আয় কমেছে। এ অবস্থায় বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোয় প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। খাদ্যশস্য, ফলমূল, শাকসবজি, মাছ দেশে উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদন হলেই তা যে দরিদ্র মানুষের ঘরে পৌঁছে যাবে, বিষয়টা তেমনও নয়। তাকেও খাবার কিনতে হয়। যে কৃষক শাকসবজি চাষ করেন, তাকে মাছ কিনতে হয়। আবার যে জেলে মাছ ধরেন, তাকে শাকসবজি বা ফলমূল কিনে খেতে হয়। এখন সময়ের সঙ্গে আয় না বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষ প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্য কিনতে পারছে না। খাবারের পরিমাণে কমবেশি করে প্রয়োজন ও সাধ্যের মধ্যে সমন্বয় করতে হচ্ছে তাদের। এতে ভারসাম্যহীনতা প্রকট হচ্ছে।

খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. শাখাওয়াত হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে পৃথিবীর সব দেশেই। বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়লেও খাদ্যনিরাপত্তায় চরম সংকটের সম্ভাবনা নেই। কেননা দেশের বেশির ভাগ মানুষের কৃষিজমি রয়েছে। আমাদের জন্য একটি ইতিবাচক দিক হলো দেশেই খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়। ফলে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে তেমন শঙ্কা নেই। সরকারের পক্ষ থেকেও দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেদিক থেকে বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে।

Source: Bonik Barta

Share the Post: