দেশের মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৮০ শতাংশ প্রতিবন্ধী। সমাজে অবহেলা-অনাদরেই কাটে তাদের জীবন। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান—প্রতি ক্ষেত্রেই হয় বঞ্চনার শিকার। অথচ তারা বোঝা নয়, একটু সহযোগিতা পেলেই সম্পদে পরিণত হতে পারে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে তাদের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। প্রতিবন্ধীদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ দ্বিতীয় পর্ব
ছয় মাস বয়সে টাইফয়েড হয় সাইদুর রহমানের। টাইফয়েড থেকে সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হন তিনি। হাত ও পায়ের সক্ষমতা হারিয়ে চলাচল থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনযাপনে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হয় তাকে। তিন বছর আগে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন ২৯ বছর বয়সী এ যুবক। তবে সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি অর্জনের জন্য তাকে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছে। শুরুতে স্নাতকের জন্য অর্থনীতিতে ভর্তি হলেও এক বছর পর লোকপ্রশাসনে ভর্তি হন সাইদুর। মূলত প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযোগী ব্যবস্থা না থাকার কারণে তাকে বিভাগ পরিবর্তন করতে হয়েছে।
তার মতে, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযোগী নয়। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো তাদের জন্য অনুপযোগী। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তাকে বহুতল অনুষদ ভবনে উঠতে হয়েছে বন্ধুদের কোলে চড়ে। আবাসিক হলেও থাকতে সহযোগিতার প্রয়োজন হয় বন্ধুদের। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পুরো সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সুবিধা নিতে পেরেছেন হাতে গোনা কয়েকদিন। হাতের সক্ষমতা না থাকায় পরীক্ষায় লিখতে গিয়ে ‘রাইটার’ নিজেকেই নির্বাচন করতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাইটারের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। অন্যদের সঙ্গে একই কক্ষে পরীক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে পড়তে হয়েছে সমস্যায়।
সাইদুরের মতো নানা প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা প্রতিবন্ধীদের হার ১০ শতাংশের কম। বাকি ৯০ শতাংশ উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে না। মূলত বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোসহ ব্যবস্থাপনার অভাব শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। দেশের ৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী প্রতিবন্ধীদের মধ্যে মাত্র ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। গত ডিসেম্বরে সংস্থাটির প্রকাশিত জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপে (এনএসপিডি) প্রতিবন্ধীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি উঠে এসেছে।
বিবিএস বলছে, প্রতিবন্ধীদের স্তরভিত্তিক শিক্ষা গ্রহণের হার সবচেয়ে কম উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে ৩৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ প্রতিবন্ধী। আর প্রাথমিক শিক্ষার সুবিধা পাচ্ছে ৫৩ শতাংশ। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের চেয়ে পুরুষরা কিছুটা পিছিয়ে। এই স্তরে শিক্ষার সুবিধাপ্রাপ্ত পুরুষের হার ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ ও নারীদের ১০ দশমিক ৫২ শতাংশ।
উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে রংপুর বিভাগের প্রতিবন্ধীরা। এ বিভাগের ১৪ শতাংশ প্রতিবন্ধী উচ্চশিক্ষার সুবিধা পেয়েছে। আর বরিশাল বিভাগে এ হার শূন্য। এছাড়া বাকি বিভাগগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামে ৬ শতাংশ, ঢাকায় ৮, খুলনায় ১১, ময়মনসিংহে ৭, রাজশাহীতে ১৩ দশমিক ৪৯ ও সিলেটে ৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুবিধা পেয়েছে।
বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১ অনুযায়ী জন্মগতভাবে, রোগাক্রান্ত হয়ে, দুর্ঘটনায় আহত হয়ে, অপচিকিত্সা বা অন্য কোনো কারণে দৈহিকভাবে বিকলাঙ্গ বা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে প্রতিবন্ধী বলা হয়। ফলে স্থায়ীভাবে আংশিক বা সম্পূর্ণ কর্মক্ষমতাহীন ও স্বাভাবিক জীবনযাপনে অক্ষম ব্যক্তিই প্রতিবন্ধী। আর ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনে মোট ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতার কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে অটিজম বা অটিজমস্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারস, শারীরিক, মানসিক অসুস্থতাজনিত, দৃষ্টি, বাক, বুদ্ধি, শ্রবণ, শ্রবণ-দৃষ্টি, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, বহুমাত্রিক ও অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা।
প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী উচ্চশিক্ষার সুবিধাবঞ্চিত রয়েছে অটিজম ও বুদ্ধিবৃত্তিক, মানসিক অসুস্থতা-অক্ষমতা ও বাকপ্রতিবন্ধীরা। এ ধরনের ব্যক্তিদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের হার শূন্য। আর শারীরিক প্রতিবন্ধীদের মধ্যে এ স্তরের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে ১৫ শতাংশ, দৃষ্টি ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের ৮ শতাংশ, একাধিক প্রতিবন্ধীরা ২ দশমিক ৩১ ও অন্য প্রতিবন্ধীদের মধ্যে ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে।
দেশের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের নিয়ে ১৯৭৭ সাল থেকে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা সুইড বাংলাদেশ। সুইডের মেন্টর জওয়াহেরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারের ঘোষণা করা ব্যবস্থা ও বাস্তবতায় মিল নেই। প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা গ্রহণের হারের ক্ষেত্রে সরকার যে প্রতিবেদন দিচ্ছে, তা অনেকার্থে সঠিক নয়। কাগজে-কলমে একটা দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩-এ প্রতিবন্ধীদের মূলধারার শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে প্রতিবন্ধীরা শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গেলে কোনো শিক্ষক না করেন না, কিন্তু ভর্তিতে যেসব কাজ করতে হয়, তা কেউ করতে চায় না। পরবর্তী সময়ে যারা মাধ্যমিকে যায় তারা ততদিনে সচেতন হওয়ার ফলেই মাধ্যমিকে যায়। এরপর উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থাপনা প্রতিবন্ধী উপযোগী নয় বলে সে পর্যন্ত কেউ যেতে পারছে না।’
তিনি মনে করছেন, ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের ১০ শতাংশও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ আইনে প্রতিবন্ধীদের জন্য সবকিছু বলা রয়েছে। উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো প্রতিবন্ধীবান্ধব নয়। একই সঙ্গে তাদের জন্য অন্যান্য যেসব ব্যবস্থা রাখা উচিত সেসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষ উদাসীন।
জরিপে বিবিএস বলেছে, দেশে ২ দশমিক ৮০ শতাংশ প্রতিবন্ধী রয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ ও নারী ২ দশমিক ৩২ শতাংশ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধীদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের হার ৩২ দশমিক ৬০ শতাংশ। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীর তুলনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি শিক্ষায় গড়ে ২ দশমিক ৩৮ বছর পিছিয়ে রয়েছে।
প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান নিয়ে গবেষণা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী। প্রতিবন্ধীদের উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণের হার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে প্রতিবন্ধীদের উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণের হার অনেক কম হতে পারে। তবে পরিবার ও সমাজে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হওয়ার পরও ৯ থেকে ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত আসতে পারছে—এটা খুবই ইতিবাচক দিক। পাশাপাশি প্রতিবন্ধী কিংবা সুস্থ-স্বাভাবিক—সব শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার আদৌ প্রয়োজন রয়েছে কিনা সেটা নিয়ে ভাবার সুযোগ রয়েছে। আমার মতে, প্রতিবন্ধীদের জন্য কর্মমুখী বিশেষায়িত শিক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। সে আলোকে জেলাভিত্তিক ন্যূনতম একটি হলেও প্রতিবন্ধীদের সব ধরনের সুযোগসংবলিত বিশেষায়িত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার। যেখানে প্রতিবন্ধিতার ধরনের আলোকে পড়ার কিংবা প্রশিক্ষণ বিষয় নির্ধারণের সুযোগ থাকবে।’
শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার কথা জানিয়েছে বিবিএস। সংস্থাটির মতে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির বাসস্থানের এলাকায় কোনো ধরনের বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকার বিষয়টি প্রধান প্রতিবন্ধকতা। এছাড়া পরিবারের সদিচ্ছার অভাব, দারিদ্র্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত দুর্বলতা, দূরত্ব, উচ্চশিক্ষার ব্যয়, প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও কারিগরি সহায়তা না পাওয়া, বিয়ে হয়ে যাওয়াসহ বেশ কয়েকটি কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।