যেকোনো বয়সের মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য পরিমিত ঘুম অপরিহার্য। ঘুমের মান ভালো না হলে অর্থাৎ বয়স অনুযায়ী পর্যাপ্ত সময় টানা ঘুম না হলে স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপের জন্য শরীর ও আত্মার প্রয়োজন ঘুম। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক গড়ে ৭-৯ ঘণ্টা ঘুমানোর প্রয়োজন হয়। দেশের উত্তরাঞ্চলের গ্রামীণ গর্ভবতীদের মধ্যে ঘুমের মান নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা যায়, সেখানের সিংহভাগ গর্ভবতীর ঘুমের গুণমান ভালো নয়। এর হার ৩৯ শতাংশ। এসব নারীর মধ্যে বিষণ্নতার উপসর্গও রয়েছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক বৈজ্ঞানিক জার্নাল সংস্থা স্প্রিংগার ন্যাচারের বায়োমেড সেন্ট্রালে ‘অ্যাসোসিয়েশন বিটুইন ডিপ্রেসিভ সিমটমস অ্যান্ড পুয়োর স্লিপ কোয়ালিটি অ্যামাং প্রেগন্যান্ট উইমেন ইন নর্দান রুরাল বাংলাদেশ: আ কমিউনিটি বেজড ক্রস সেকশনাল স্টাডি’ শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে বিষয়টি উঠে এসেছে। গবেষণাটি করা হয়েছে নীলফামারী জেলার ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ৪৭৫ গর্ভবতী নারীর ওপর। ২০২১ সালের মে থেকে জুন পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে করা গবেষণাটি চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশ পায়। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন গবেষক গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন।
গবেষণায় বলা হয়, ৩৯ শতাংশ গর্ভবতী নারীর ঘুমের গুণমান ভালো নয়। পিটসবার্গ স্লিপ কোয়ালিটি ইনডেক্স (পিএসকিউআই) অনুযায়ী তাদের স্কোর পাঁচের বেশি। যেসব গর্ভবতীর ঘুমের মান ভালো তারা সূচকের ৪ দশমিক ৪ স্কোরে অবস্থান করছেন। যাদের ভালো ঘুম হচ্ছে তাদের মধ্যে ৭২ শতাংশ টানা পর্যাপ্ত সময় ঘুমিয়েছেন, ঘুমের জন্য বিছানায় গিয়েও ৪৮ শতাংশের ঘুমাতে সময় লেগেছে ১৬ থেকে ৩০ মিনিট, ঘুমানোর সময় ও বিলম্বের সময় মিলিয়ে (হ্যাভিচুয়াল স্লিপ এফিশিয়েন্সি) ছিল ৭৭ শতাংশের মধ্যে, ৭৪ শতাংশ রাতে ৭ ঘণ্টার বেশি ঘুমিয়েছেন, ৯০ শতাংশ গর্ভাবস্থায় ঘুমের ওষুধ সেবন করেননি, ঘুমের মধ্যে ৭৭ শতাংশ বিঘ্ন অনুভব করেছেন এবং ৪৮ শতাংশের ক্ষেত্রে দিনে ঘুম ঘুম ভাব ছিল।
পিএসকিউআই অনুযায়ী, তথ্যদাতা ঘুমের গুণমান কীভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, ঘুমাতে বিছানায় গিয়েও ঘুমের বিলম্ব, ঘুমের সময়কাল, অভ্যাসগত ঘুমের কার্যকারিতা, ঘুমের ব্যাঘাত, ঘুমের ওষুধের ব্যবহার ও দিনের বেলায় কর্মহীনতার মূল্যায়ন করে ভালো বা খারাপ ঘুম নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিটি সাবস্কেলের সম্ভাব্য স্কোর শূন্য থেকে ৩ ধরা হয়েছে। বৈশ্বিকভাবে এ স্কোর শূন্য থেকে ২১ পর্যন্ত। কারো স্কোর ৫-এর কম থাকলে তাকে ভালো ঘুম আর ৫-এর সমান অথবা বেশি থাকলে তাকে খারাপ ঘুম বলা হয়।
গবেষণা বিশ্লেষণে দেখা যায়, যেসব গর্ভবতীর মধ্যে বিষণ্নতাজনিত উপসর্গ ছিল, তাদের অন্যদের তুলনায় খারাপ ঘুম হয়েছে আড়াই গুণ বেশি। বিষণ্নতার উপসর্গ ও গর্ভবতী নারীর খারাপ ঘুমের মানের মধ্যে একটি সম্পর্ক এতে উঠে এসেছে।
গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে বিষণ্নতাজনিত উপসর্গ এবং খারাপ ঘুমের মানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক সম্পর্ক পাওয়া গেছে। ঘুমের ব্যাধি ও হতাশাজনক লক্ষণগুলো শিশুর অকাল জন্মের কারণ হতে পারে। ঘুমের সমস্যাগুলো গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ ও সিজারিয়ান (অস্ত্রোপচার) ডেলিভারির মতো প্রতিকূল ফলাফলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে। তাছাড়া প্রসূতির মানসিক বৈকল্য, গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস, শিশুর অকালজন্ম, জন্মের ধরন, প্রসব বেদনার সময়কাল, শিশুর ওজন, অ্যাপগার স্কোর (জন্মের ১ থেকে ৫ মিনিটের মধ্যে মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে স্বাস্থ্যের একটি মূল্যায়ন পদ্ধতি, যা চিকিৎসকরা ব্যবহার করে থাকেন) ঘুমের গুণমান ও ঘুমের সময়কাল দিয়ে প্রভাবিত হতে পারে। গবেষণায় অংশ নেয়া জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশের ঘুমের মান খারাপ ছিল। তাদের প্রায় ১০ শতাংশের মধ্যে ছিল বিষণ্নতার উপসর্গ। শিক্ষাগত যোগ্যতা, অর্থনৈতিক অবস্থা, পেশা ও পরিবারের সামাজিক অবস্থান ঘুমের মানকে প্রভাবিত করেছে। গর্ভাবস্থায় হতাশাজনক লক্ষণগুলোর বিকাশের প্রাথমিক কারণ হলো হরমোনের অনিয়মিত পরিবর্তন। আর্থসামাজিক কারণে গর্ভবতী নারীদের হতাশাজনক লক্ষণগুলোর সঙ্গে ঘুমের সংযোগ রয়েছে।
গবেষকদের অন্যতম মো. মাহবুবুল আলম শাওন বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা মূলত দেশের উত্তরাঞ্চলের গর্ভবতীদের ঘুমের মান দেখার চেষ্টা করেছি। এর সঙ্গে বিষণ্নতার উপসর্গের সম্পর্কও উপস্থাপন করেছি। ঠিক কী কী কারণ ঘুমের মান খারাপ হওয়াকে প্রভাবিত করছে তা এরপর অধিকতর গবেষণায় হয়তো উঠে আসবে। ঘুম মানবস্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও গ্রামীণ গর্ভবতীদের বেলায় বিষয়টি উপেক্ষিত রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টানা ১৬ ঘণ্টা নির্ঘুম কাটালেই মানুষ মানসিক ও শারীরতাত্ত্বিকভাবে ভেঙে পড়তে শুরু করে। ১৯ থেকে ২০ ঘণ্টা টানা না ঘুমিয়ে থাকলে কারো মানসিক ও শারীরিক অবস্থা মাতালের সমতল হয়ে দাঁড়ায়। আর এসব কাটিয়ে সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজন দিনে গড়ে ৮ ঘণ্টা ঘুম। গর্ভাবস্থায় ঘুম অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একটি ভালো গর্ভাবস্থার ফলাফলের জন্য অতিরিক্ত ঘুম প্রয়োজন। গর্ভধারণের শুরু থেকে প্রসব পর্যন্ত, গর্ভাবস্থা ও ঘুমের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ঘুম-সম্পর্কিত সমস্যাগুলো গর্ভবতী নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তন ঘুমের ধরনকে প্রভাবিত করে। এ সময় শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনও নিয়মিত ঘুম ব্যাহত করতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
বাংলাদেশে প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনিকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ বা ওজিএসবির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরীর মতে, গর্ভাবস্থায় সাধারণত উচ্চরক্তচাপ বা অন্য কোনো সমস্যা না থাকলে ঘুমের সমস্যা হওয়ার কথা না। উত্তরাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে তামাক ও জর্দা খাওয়ার প্রবণতা বেশি। বিভিন্ন কারণে ঘুমের সমস্যা হতে পারে।
তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কর্মজীবী নারীরা সংসারের কাজকর্ম করছেন। শতভাগ না করতে পারলেও তারা চাকরির পাশাপাশি সংসারের কাজ করেন। বাইরের কাজের ক্ষেত্রে একজন পুরুষ যতটা দুশ্চিন্তায় থাকেন কর্মজীবী নারীরাও ততটা দুশ্চিন্তায় ভোগেন। পারিবারিক সমস্যাটা পুরুষদের ততটা না থাকলেও নারীদের ক্ষেত্রে প্রকট। সব সময়ই ঘরে-বাইরে তারা মানসিক একটা চাপের মধ্যে থাকেন। একই সঙ্গে বেশি বয়সে যারা গর্ভধারণ করছেন তাদের মধ্যে ঘুমের মান খারাপের প্রবণতা বেশি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক চাপও বেড়ে যায়।’
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশন এবং রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) পরামর্শপত্র অনুযায়ী, নবজাতকের (শূন্য থেকে তিন মাস) ক্ষেত্রে দৈনিক ১৪ থেকে ১৭ ঘণ্টা, ৪ থেকে ১২ মাস বয়সী শিশুর জন্য ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা, এক থেকে দুই বছর বয়সী শিশুর জন্য ১১ থেকে ১৪ ঘণ্টা, তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সীর ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৩ ঘণ্টা, ছয় থেকে ১২ বছর বয়সীদের জন্য ৯ থেকে ১২ ঘণ্টা, কৈশোর বয়সে (১৩ থেকে ১৮ বছর বয়স) আট থেকে ১০ ঘণ্টা, ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের জন্য ৭ ঘণ্টা বা তার বেশি সময়, ৬১ থেকে ৬৪ বছর বয়সীদের জন্য ৭ থেকে ৯ ঘন্টা এবং ৬৫-ঊর্ধ্বদের ক্ষেত্রে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা দৈনিক ঘুমানো প্রয়োজন।
গর্ভাবস্থায় একজন নারীর জীবনে মেজাজ ও স্বাস্থ্যের পরিবর্তন ঘটে। ফলে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, হতাশাজনক উপসর্গ, খারাপ ঘুম ও জীবনের মান খারাপ হয়। এর আগে ময়মনসিংহের দুটি উপজেলায় পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ গর্ভবতীর মধ্যে প্রসবপূর্ব হতাশার লক্ষণ রয়েছে। চাঁদপুর জেলার গ্রামীণ এলাকা মতলবে পরিচালিত আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৮২ শতাংশ নারীর মধ্যে বিষণ্নতার লক্ষণ রয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশন অব সার্জনস ফর স্লিপ অ্যাপনিয়া বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ও সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের নাক, কান ও গলা বিভাগের অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু বণিক বার্তাকে বলেন, ভালো থাকার জন্য ভালো ঘুম হওয়া একান্ত প্রয়োজন। তবে অনেকেই আছে যাদের মোটেও ভালো ঘুম হয় না। গর্ভবতীদের দৈনিক ৮ ঘণ্টা করে ঘুমানো প্রয়োজন। এ ঘুম হতে হবে একটানা। কোনো ধরনের ব্যাঘাত ঘটতে পারবে না। ঘুমের মধ্যে হাঁটাহাঁটি, দুঃস্বপ্ন, হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ার মতো কারণ ছাড়া গভীর ঘুমকে ভালো ঘুম বলা হয়। ঘুম ঠিকমতো না হলে মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। সব ধরনের মানসিক সমস্যার সঙ্গে ঘুম না হওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। বংশগতভাবে মানসিক রোগ হওয়ার জন্য দায়ী জিনগুলোর বৈশিষ্ট্যের অনেক কাছাকাছি জিনের কারণেই ঘুমের মান খারাপ হয়।