ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে দেশের উত্তর-মধ্যাঞ্চল ও মধ্য-পূর্বাঞ্চলের অন্তত ১০টি জেলা ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি জেলার সিংহভাগ এলাকা পুরোপুরি পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর বেশির ভাগ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানও তলিয়ে গেছে পানিতে। ফলে ভেঙে পড়েছে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গতকাল জানিয়েছে, দেশের উত্তর-মধ্যাঞ্চলের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। পানিতে নিমজ্জিত এসব এলাকার জেলা-উপজেলাসহ অনেক কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। তাই জরুরি সেবা চলমান রাখার জন্য সহস্রাধিক ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা দল প্রস্তুত রেখেছে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।
চলমান বন্যা পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে ফেনীতে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জেলার ৯০ শতাংশ এলাকা পানিতে পুরোপুরি তলিয়ে গেছে। ছয় উপজেলা পানিতে নিমজ্জিত। ফলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর নিচতলায় পানি উঠেছে অন্তত ছয়-সাত ফুট। একই সঙ্গে জেলা শহরে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের নিচতলা, কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলো নিম্নাঞ্চলে হওয়ায় সবই পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। জেলাটির সব উপজেলা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এরই মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় জানিয়েছে।
কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন সূত্রে জানা যায়, জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে ১০টি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এর মধ্যে চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট, লাকসাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিচতলায় চার-পাঁচ ফুট পানি উঠেছে। ফলে বন্ধ রয়েছে চিকিৎসা কার্যক্রম। একই সঙ্গে মনোহরগঞ্জ, তিতাস, বুড়িচং, সদর দক্ষিণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। জেলার বেশির ভাগ ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক প্লাবিত হয়েছে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কার্যত ভেঙে পড়লেও জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা যেন ব্যাহত না হয় তার জন্য চেষ্টা চলছে বলে বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন কুমিল্লার সিভিল সার্জন ডা. নাছিমা আকতার। তিনি বলেন, ‘পানির স্তর এতই বেড়েছে যে মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসছে না। তবে কেউ যদি হাসপাতালে আসে বিনা চিকিৎসায় ফিরে যাবে না। যেসব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের নিচতলা ডুবে গেছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় তলায় কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। তবে পানির পরিমাণ সময়ে সময়ে বাড়ছে। আমরা মানুষের স্বাস্থ্যসেবার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ইউনিয়ন, উপজেলাভিত্তিক জরুরি চিকৎসা টিম প্রস্তুত করেছি। তারা মানুষের কাছে গিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ বিতরণ করছে। খাওয়ার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটসহ যেসব ওষুধ প্রয়োজন তা আমরা মজুদ রেখেছি।’
পানির পরিমাণ বাড়তে থাকলে লক্ষ্মীপুরের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো তলিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. আহাম্মদ কবীর। গতকাল বিকালে সেলফোনে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত উপজেলা বা জেলা হাসপাতাল পানিতে নিমজ্জিত হয়নি। তবে পানি বিপৎসীমার ওপরে রয়েছে। যেকোনো সময় প্রবেশ করতে পারে। আমরা চিকিৎসা যন্ত্রাংশ সরিয়ে নিতে শুরু করেছি। জেলায় ৬৪টি চিকিৎসা দল প্রস্তুত করে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। তবে পানি যে গতিতে বাড়ছে তাতে এ জেলার অবস্থাও যেকোনো সময় খারাপ হয়ে যেতে পারে।’
এদিকে বন্যাকবলিত এলাকার জন্য আটটি নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় চিকিৎসা সরঞ্জাম, চিকিৎসক-নার্সদের কর্মস্থলে থাকা এবং স্থানীয় প্রশাসনের কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে সার্বক্ষণিক সমন্বয় ও যোগাযোগ রাখাসহ বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হয়। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসানের সই করা এক নির্দেশনায় এসব তথ্য জানানো হয়।
নির্দেশনায় বন্যাকবলিত এলাকার সিভিল সার্জন এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয়ে সার্বক্ষণিক কন্ট্রোল রুম চালু করতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জামাদিসহ মেডিকেল টিম গঠন করতেও।
একই সঙ্গে সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমন ডায়রিয়া, সর্প দংশনসহ বন্যাসংক্রান্ত অন্যান্য রোগের চিকিৎসার জন্য যথোপযুক্ত প্রস্তুতি রাখতে বলা হয়েছে স্থানীয় স্বাস্থ্য প্রশাসনকে। বন্যাদুর্গত হাসপাতালগুলোয় সব ধরনের যন্ত্রপাতি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য উঁচু স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। জরুরি ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রী মজুদ এবং প্রাথমিক চিকিৎসাসামগ্রীসহ অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখতে হবে। বন্যাদুর্গত জেলাগুলোর সব চিকিৎসক, নার্সসহ সব কর্মকর্তা-কর্মচারী বিভাগীয় পরিচালকের (স্বাস্থ্য) অনুমতি ছাড়া কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারবেন না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য বন্যাদুর্গত এলাকার সিভিল সার্জন ও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের অনুরোধ করা হলো। বন্যা মোকাবেলায় স্থানীয় প্রশাসনের এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ কর্তৃক গঠিত কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে সার্বক্ষণিক সমন্বয় ও যোগাযোগ রাখতে হবে।
দুর্গত উপজেলাগুলোয় যোগাযোগ করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. ইফতেখার আহমদ। বণিক বার্তাকে তিনি জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নয়টি উপজেলার মধ্যে কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কুমিল্লার ১৭টি উপজেলার মধ্যে ১০টি, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও ফেনীর সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিচতলা পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এরই মধ্যে বিভাগের ১ হাজার ২২১টি জরুরি মেডিকেল টিম প্রস্তুত করা হয়েছে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে এসব চিকিৎসা টিম স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। একতলাবিশিষ্ট স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র সেবা দেয়ার মতো পরিস্থিতিতে নেই। উপজেলাগুলোর কয়েক হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সর্বশেষ পরিস্থিতি গতকাল জানতে পারেনি বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ।
বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘মানুষ সেবা নিতে আসবে এমন পরিস্থিতি অনেক উপজেলায় নেই। কোথাও কোথাও রাস্তায় ছয়-সাত ফুট বা তার ওপরেও পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তবে এ মুহূর্তে যেন মানুষ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত না হয় তার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। আমাদের টিম মানুষের কাছে যাচ্ছে।’
এদিকে দেশের উত্তর-মধ্যাঞ্চলের জেলা মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বন্যা শুরু হয়ে গেছে। এসব জেলায় উজানের পাহাড়ি ঢলে পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। অতিমাত্রার বৃষ্টিপাতের কারণেও পানির স্তর বেড়েছে নদী ও খালগুলোয়। মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন বণিক বার্তাকে জানান, চলমান বন্যায় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিকে পানি প্রবেশ করেছে। এছাড়া রাজনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আঙিনায় পানি প্রবেশ করে স্বাস্থ্যসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে।
এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বলেছে, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে সাম্প্রতিক আকস্মিক বন্যায় দুই বিভাগে ৪০টি উপজেলার ২৬০টি ইউনিয়ন আক্রান্ত হয়। এসব এলাকায় ১ হাজার ১৯৬টি মেডিকেল টিম সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করছে।