এখনো আসেনি টিকার মিশ্রণ: সামান্য ভুলে নষ্ট হতে পারে ফাইজারের টিকা

গত সোমবার রাতে ঢাকায় পৌঁছেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) উদ্যোগে গঠিত আন্তর্জাতিক প্লাটফর্ম কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি থেকে পাওয়া ফাইজারের ১ লাখ ৬২০ ডোজ টিকা। বিমানবন্দর থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা টিকা বুঝে পাওয়ার পর তা রাখা হয়েছে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) সংরক্ষণাগারে। বিনা মূল্যে পাওয়া ফাইজারের এ টিকা ২৮ দিনের ব্যবধানে দুই ডোজ করে দেয়া হবে। ১২ বছর বা তার বেশি বয়সীদের ওপর প্রয়োগযোগ্য টিকাটি ৯৫ শতাংশ কার্যকর বলে চূড়ান্ত ধাপের ট্রায়ালে প্রমাণ মিলেছে। মাইনাস ৯০ ডিগ্রি থেকে মাইনাস ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সংরক্ষণে বাধ্যবাধকতা থাকলেও ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এটি পাঁচদিন রাখা যাবে। তবে রেফ্রিজারেটরের বাইরে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এ টিকা ২ ঘণ্টা কার্যকর থাকবে।

ফাইজারের টিকা প্রয়োগের জন্য গত ৩১ মে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে এক সভার মাধ্যমে ‘ফাইজার ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম-এর কর্মপ্রণালি ঠিক করা হয়। এতে টিকা প্রয়োগের জন্য ব্যবস্থাপনা, টিকাদান কেন্দ্র, টিকাগ্রহীতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। টিকাদান কেন্দ্রে টিকা সরবরাহ, সংরক্ষণ, ব্যবহার ও সতর্কতাও উল্লেখ করা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ফাইজারের টিকা প্রয়োগের আগে এতে ডাইলুয়েন্ট নামক মিশ্রণ মেশাতে হবে। এক ভায়াল টিকার সঙ্গে ডাইলুয়েন্ট মেশানোর পর মোট ছয় ডোজ টিকা তৈরি হবে। এমআরএনএ ভিত্তিক জমে থাকা এ টিকা জীবাণুমুক্ত রেখে সংমিশ্রণের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। টিকা আল্ট্রা কোল্ড ফ্রিজার থেকে বের করার পর ৬ ঘণ্টার মধ্যে ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রেখেই গলিয়ে ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। ডাইলুয়েন্ট মেশানোর আগে টিকার ভায়াল কক্ষের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ১০-১৫ মিনিট রাখতে হবে। মিশ্রিত দ্রবণকে আর জমতে দেয়া যাবে না। একই সঙ্গে কক্ষের বাতি, সূর্যের আলো ও আলট্রা ভায়োলেট আলোর সংস্পর্শ এড়িয়ে রাখতে হবে। দশমিক ৬ লিটারের চারটি আইসপ্যাকসহ টিকা বহনকারী বাক্সে করে এসব টিকা কেন্দ্রে নেয়া হবে।

টিকা দেশে পৌঁছলেও ডাইলুয়েন্ট নামক মিশ্রণ এখনো আসেনি। ১০ দিনের মধ্যে এ মিশ্রণ পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, এ টিকা এসেছে, কিন্তু মিশ্রণ আসেনি। এ মিশ্রণ আসতে ১০ দিনের মতো সময় লাগতে পারে। কোভ্যাক্স এ মিশ্রণ পাঠাবে। এ মিশ্রণের সমন্বয়ে ডোজ প্রস্তুত করে টিকা প্রয়োগ করতে হবে। নির্ধারিত পরিমাণে মিশ্রণ এবং মিশ্রণের পর ব্যবস্থাপনার জন্য ফাইজারের টিকা প্রয়োগ কিছুটা জটিল বলে মনে করেন সরকারের এ শীর্ষ কর্মকর্তা।

পরীক্ষামূলক প্রয়োগে তুলনামূলকভাবে কোভিশিল্ডের চেয়ে বেশি কার্যকারিতা দেখা গেলেও ফাইজারের টিকা সংরক্ষণ, সরবরাহ ও প্রয়োগের আগে টিকার সংমিশ্রণে জটিলতা রয়েছে। এসবের মধ্যে ত্রুটি হলে টিকা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এ টিকার মূল প্রতিবন্ধকতা হলো অতি কম তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা। রাজধানীর বাইরে এ টিকা সংরক্ষণের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। মাইনাস ৬০-৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রার ফ্রিজ ঢাকায় যা আছে তাতে মাত্র পাঁচ লাখ টিকা সংরক্ষণ করা যাবে।

ফাইজারের টিকার ব্যবস্থাপনায় জটিলতা থাকায় বাংলাদেশ এ টিকা কিনছে না উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, ফাইজারের টিকা অন্যান্য টিকার চেয়ে বেশি কার্যকর বলে প্রমাণিত, তবে এর সংরক্ষণ প্রক্রিয়া অনেক কঠিন। যে তাপমাত্রায় এ টিকা সংরক্ষণ করতে হয়, তা আমাদের দেশে খুবই সীমিত। ঢাকার বাইরে এর সুযোগ কম। টিকা সংরক্ষণ ও পরিবহনও কঠিন। টিকাটি প্রয়োগের সময় সংমিশ্রণের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে করতে হবে। এর মধ্যে ত্রুটি রাখা যাবে না। ত্রুটি হলে টিকার ডোজ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ব্যবস্থাপনা জটিলতার কারণে শুরু থেকেই এ টিকা কিনতে বাংলাদেশ আগ্রহী হয়নি বলেও জানান তিনি।

ইপিআই সূত্রে জানা যায়, ফাইজারের প্রয়োগযোগ্য টিকার প্রতি ডোজ দশমিক ৩ এমএল পরিমাণ। টিকা সংমিশ্রণের জন্য এক ধরনের সিরিঞ্জ ও মানবদেহের বাহুর উপরিভাগে মাংসপেশির ভেতর প্রয়োগ করতে বিশেষ আরেক ধরনের সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে হবে। টিকার সঙ্গে এ দুই ধরনের সিরিঞ্জই পাঠিয়েছে কোভ্যাক্স। ফাইজারের টিকার প্রথম ডোজ বা অন্য কোনো টিকার প্রয়োগের মধ্যে ন্যূনতম ১৪ দিনের বিরতি থাকতে হবে। এরপর প্রয়োগ করা হবে দ্বিতীয় ডোজের টিকা। দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগের সময় মৃদু বা মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে বিবেচনায় আনতে হবে।

করোনার টিকা প্রাপ্তির জন্য সুরক্ষা ওয়েবসাইটে নিবন্ধনকৃতরা এ টিকা পাবেন বলে নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়। টিকা সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যবস্থা না থাকার কারণে রাজধানীর বাইরে তা প্রয়োগ করা হবে না। রাজধানীর চারটি কেন্দ্রে এ টিকা দেয়া হবে। কেন্দ্রগুলো হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট।

যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ কোম্পানি ফাইজার ও জার্মান জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেকের তৈরি এ টিকা এরই মধ্যে দেশে প্রয়োগের অনুমোদন পেয়েছে। গত ২ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্য ফাইজারের টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমতি দেয়। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে এখন এ টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও গত ৩১ ডিসেম্বর তাদের জরুরি ব্যবহার্য টিকার তালিকায় ফাইজারকে যুক্ত করে।

বাংলাদেশে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে প্রস্তুতকৃত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ‘কোভিশিল্ড’ টিকা দিয়ে গণটিকাদান শুরু করে সরকার। তবে চুক্তি অনুযায়ী টিকার সরবরাহ না পাওয়ায় বাধার মুখে পড়ে টিকা কার্যক্রম। কোভিশিল্ডের প্রথম ডোজ পাওয়া সাড়ে ১৪ লাখ ব্যক্তি দ্বিতীয় ডোজ পাচ্ছেন না। এর মধ্যে নতুন উৎস হিসেবে চীনের সিনোফার্ম ও রাশিয়ার স্পুটনিক-৫ টিকা কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে চীন পাঁচ লাখ ডোজ টিকা উপহার পাঠালে তা প্রয়োগও শুরু হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন-গ্যাভি ও সংক্রামক রোগের টিকা তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক সংস্থার (সিইপিআই) নেতৃত্বে ১৯০টি সদস্য দেশ নিয়ে গড়ে ওঠে কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি। জোটটি বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের জন্য বিনা মূল্যে টিকা সরবরাহ করবে। এতে টিকার ডোজের পরিমাণ দাঁড়াবে ৬ কোটি ৮০ লাখে।

Source: Bonik Barta

Share the Post: