জাতীয় অধ্যাপক ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এমআর খানের হাত ধরে নব্বই দশকের শেষের দিকে প্রতিষ্ঠা পায় সেন্ট্রাল হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠার পর প্রায় দেড় দশক শিশু ও মাতৃ চিকিৎসাসেবায় সুনাম অর্জন করেছিল রাজধানীর গ্রিন রোডের বেসরকারি এ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রটি। তবে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা, অপচিকিৎসা ও চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ উঠতে শুরু হয়। সম্প্রতি ভুল চিকিৎসায় নবজাতকসহ প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনায় আবারো আলোচনায় সেন্ট্রাল হাসপাতাল। অভিযোগ রয়েছে, কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসকের অনুপস্থিতির বিষয়টি গোপন করে দেয়া হয়েছে ভুল চিকিৎসা। নবজাতকের মৃত্যুর পর ঘটনাটি ব্যাপক আলোচনায় এলে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে সাত দফা বিধিনিষেধ দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নিষেধাজ্ঞা আসে অস্ত্রোপচারের ওপর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, একুশে পদকপ্রাপ্ত ডা. এমআর খানের মৃত্যুর পর সেন্ট্রাল হাসপাতাল থেকে তার নাম মুছে ফেলার চেষ্টা চালায় পরিচালনা পর্ষদের একটি অংশ। অবশ্য জীবদ্দশাতেই তিনি হাসপাতালের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলেন। তখনই কর্তৃত্ব চলে যায় পরিচালনা পর্ষদের কিছু সদস্যের হাতে। অতিমুনাফার লোভে রোগীবান্ধব সেবাকেন্দ্রটিতে অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করা হয়। চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় মোটা অংকের টাকা। চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ এনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলাও হয় বেশ কয়েকবার।
জানা গেছে, সেন্ট্রাল হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন কুমিল্লার প্রসূতি মাহবুবা রহমান আঁখি। এর মধ্যে ৯ জুন প্রসব ব্যথা উঠলে ওই প্রসূতিকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে আনা হয়। ভর্তি করা হয় ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে। যদিও সেদিন ওই চিকিৎসক হাসপাতালে ছিলেন না, যা রোগীর স্বজনদের কাছে গোপন করা হয়। উল্টো আঁখির স্বামী ইয়াকুব হোসেনকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, সন্তান প্রসবের চিকিৎসা সম্পর্কিত সবকিছু ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনেই হচ্ছে! পরিবারের অনুমতি না নিয়েই মধ্যরাতে আঁখির অস্ত্রোপচার করা হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পর মারা যায় তার নবজাতক। এদিকে অস্ত্রোপচারের পর প্রসূতির অবস্থারও অবনতি হয়। পরদিন বিকালে তাকে ভর্তি করা হয় পাশের ল্যাবএইড হাসপাতালে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল দুপুরে মাহবুবা রহমান আঁখির মৃত্যু হয়।
চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ এনে বুধবার ধানমন্ডি থানায় মামলা করেন আঁখির স্বামী ইয়াকুব। এতে আসামি করা হয় ডা. সংযুক্তা সাহা, হাসপাতালটির গাইনি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসক, ব্যবস্থাপকসহ কয়েকজনকে। সেই মামলায় ডা. সংযুক্তা সাহার দুই সহযোগী ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা ও ডা. মুনা সাহাকে ওইদিন রাতেই গ্রেফতার করে পুলিশ। পরদিন তাদের আদালতে তোলা হলে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হন। জবানবন্দি রেকর্ড করে বিচারক এ দুই চিকিৎসককে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
জানতে চাইলে ইয়াকুব হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমার স্ত্রীর প্রসব ব্যথা ওঠার পর কুমিল্লা থেকে রওয়ানা দেয়ার আগেই হাসপাতালে (সেন্ট্রাল) ফোন করে ডা. সংযুক্তা সাহা আছেন কিনা জানতে চাই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত করে। হাসপাতালে এলে কর্তৃপক্ষ তখন জানায়, ডা. সংযুক্তা অস্ত্রোপচারের কক্ষে রয়েছেন। তিনিই মাহবুবার চিকিৎসা করবেন। তবে আমরা যখন বুঝতে পারি ওই চিকিৎসক নেই, তখনও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে যে, তিনি আছেন।’
ইয়াকুব আরো বলেন, ‘আমার স্ত্রীর কোনো জটিলতা ছিল না। হাসপাতালে সে হেঁটেই উঠেছে। ওইদিন রাত ২টার দিকে তার অস্ত্রোপচার হয়। কিন্তু তার চিকিৎসার পরিস্থিতি কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে গোপন করেছে। দুই চিকিৎসক ভুল অস্ত্রোপচার করেছেন। এতে আঁখির পেটের বিভিন্ন অংশ কেটে যায়। রক্তপাত হয়। আমাদের সন্তানের মৃত্যু হয়।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ডা. সংযুক্তা সাহার বিরুদ্ধে রোগীদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে রোগীদের প্রভাবিত করে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি হতে উদ্বুদ্ধ করেন। মাহবুবা রহমান আঁখির ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটিই ঘটেছে বলে জানান ইয়াকুব হোসেন। তবে রোগীকে প্রভাবিত করা চিকিৎসার নীতিবিরুদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর।
জানা যায়, চিকিৎসক সংযুক্তা সাহা ২০২০ সালের নভেম্বরে চিকিৎসার নৈতিকতা লঙ্ঘনের কারণে শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ থেকে চাকরি হারান। জানতে চাইলে ওই মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমি ২০২০ সালের আগস্টে এ কলেজে যোগদান করি। আর সংযুক্তা সাহাকে চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয় নভেম্বরে। এর কিছুদিন আগে তিনি অধ্যাপক হন। সংযুক্তা সাহা যে কাজ করেছেন এর পরও তাকে কলেজে রাখার কোনো কারণ ছিল না। তবে কী কারণ তা বলতে চাচ্ছি না। বিষয়টি চিকিৎসা সংক্রান্ত।’
এ বিষয়ে জানতে দুদিন ধরে ডা. সংযুক্তা সাহার সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। শনিবার তার সেলফোনে কল করা হলে ওপাশ থেকে একজন তা রিসিভ করেন। তবে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর লাইন কেটে দেন।
অধ্যাপক ডা. কাজী জাহাঙ্গীর এর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (হাসপাতাল) দায়িত্বে ছিলেন। তখনকার প্রসঙ্গ টেনে এনে তিনি বলেন, ‘আমার দায়িত্ব পালনের সময় সেন্ট্রাল হাসপাতাল সম্পর্কে অনেক অভিযোগ ছিল। অধ্যাপক ডা. এমআর খান জাতীয় পর্যায়ের একজন শিক্ষক ছিলেন। তার শেষ বয়সে আর ওই হাসপাতাল দেখাশোনা করতে পারতেন না। তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। এমআর খান স্যারের শেয়ার নিয়েও ঝামেলা করা হয়েছে বলে শুনেছি। তবে কোনো লিখিত অভিযোগ তখন আমাদের কাছে আসেনি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে জানান, রোগীবান্ধব একটি হাসপাতালকে বানানো হয়েছে প্রতারণার প্রতিষ্ঠান। সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিরুদ্ধে বহু বছর ধরে বিভিন্ন অভিযোগ এসেছে। এখানে রোগীদের গোপনীয়তা রক্ষা করা হয় না। বিশেষায়িত সেবার নামে মোটা অংকের বিল করা হয়। সাধারণত যে একবার এ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গিয়েছেন তিনি আর দ্বিতীয়বার যান না। বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে অভিযানও চালানো হয়। তবে তাতে ফলপ্রসূ কিছু করা যায়নি।
সেন্ট্রাল হাসপাতালের সর্বশেষ ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বলে জানিয়েছেন অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. শেখ দাউদ আদনান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ওই হাসপাতালের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত করতে কমিটি করা হয়েছে। তবে মালিকানা নিয়ে যে দ্বন্দ্বের কথা বলা হচ্ছে তা নিয়ে এখন মন্তব্য করতে পারছি না। এটি আদালতের বিষয়।’
এদিকে নবজাতকের মৃত্যুর পর গত শুক্রবার সেন্ট্রাল হাসপাতাল পরিদর্শন করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় হাসপাতালটির বিরুদ্ধে বেশকিছু বিধিনিষেধ জারি করা হয়। এর মধ্যে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ও জরুরি সেবার মান সন্তোষজনক না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লিখিত অনুমোদন ছাড়া বিশেষজ্ঞ সেবা দিতে পারবেন না ডা. সংযুক্তা সাহা। এছাড়া ভুক্তভোগী পরিবারের চিকিৎসা ব্যয় বহন, ওই রোগীর সব চিকিৎসক ও চিকিৎসাসংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্র বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) পাঠানো, আদালতে চলমান মামলায় অভিযুক্ত চিকিৎসকদের খরচ বহনসহ বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।
সেন্ট্রাল হাসপাতালে ২০১৭ সালের মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হাসপাতালটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলে গ্রেফতার হন বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এমএ কাশেম। অভিযোগে বলা হয়, ডেঙ্গু হলেও ওই ছাত্রীকে দেয়া হয় ক্যান্সারের চিকিৎসা। সে কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে।
মালিকানা সংক্রান্ত বিষয়, চিকিৎসা অবহেলা, রোগীদের প্রতারিত করার অভিযোগের বিষয়ে পরিচালক ডা. এমএ কাশেমের মন্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালে চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগ সত্য নয়। ওই ছাত্রী সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে এসেছিল। আমি অন্য কোনো বিষয়ে মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসা অবহেলা হচ্ছে পেশাদারদের মাধ্যমে প্রতিশ্রুত স্বাস্থ্য অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অবহেলার সঙ্গে চিকিৎসাসংক্রান্ত ত্রুটি জড়িত। বিষয়টি রোগীকে আহত বা মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। যদিও বাংলাদেশে চিকিৎসায় অবহেলার কারণে কতসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয় বা আহত হচ্ছেন তার সঠিক হিসাব নেই।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেসব বিশেষায়িত হাসপাতালে আইসিইউসহ অন্যান্য সেবার মান ঠিক নেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’