আফ্রিকান অঞ্চল ছাড়াও এমপক্স বা মাংকিপক্স এরই মধ্যে এশিয়ার একাধিক দেশে শনাক্ত হয়েছে। অতিসংক্রামক এ রোগ সম্পর্কে সতর্ক অবস্থান নেয়ার কথা জানিয়েছে সরকার। আন্তর্জাতিক স্থল ও বিমানবন্দরগুলোয় সতকর্তা জারি করা হয়েছে। আক্রান্ত সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও রোগীকে আইসোলেশনে রাখতে রাজধানীসহ দুটি বড় শহরে হাসপাতাল প্রস্তুত করছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে এ রোগ সম্পর্কে জনসচেতনতার জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে নিদের্শনাও দেয়া হয়েছে।
আফ্রিকার দেশগুলোয় এমপক্স ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্বব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। ১৪ আগস্ট এক বিবৃতিতে সংস্থাটির মহাপরিচালক টেড্রোস অ্যাডহ্যানম গেব্রেইসুস দেশগুলোকে সতর্ক করেন। এরই মধ্যে ৫০০-এর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে এ রোগে। আফ্রিকার কয়েকটি দেশসহ এশিয়ার দেশ পাকিস্তান, ফিলিপিন ও থাইল্যান্ডেও এমপক্সের রোগী শনাক্ত হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী সতর্কতা জারির পর বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সতকর্তার কথা জানিয়েছে। সর্বশেষ গত ১৭ ও ১৯ আগস্ট জরুরি সভা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, হটলাইন চালু করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বন্দরে জারি করা হয়েছে সতর্কতা। আক্রান্ত সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আইসোলেশন (বিচ্ছিন্নকরণ) ও চিকিৎসার জন্য পাঁচটি হাসপাতাল প্রস্তুত করা হয়েছে। সরকারি এসব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো রাজধানীতে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, চট্টগ্রামে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) হাসপাতাল, সিলেট শহীদ সামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ-সিডিসি) ও লাইন ডিরেক্টর (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. শেখ দাউদ আদনান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এরই মধ্যে ২২টি দেশে এ রোগ শনাক্ত হয়েছে এবং ছড়িয়ে পড়েছে। এত বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়ায় আমাদের দুশ্চিন্তা বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনে আমরা সব প্রস্তুতি নিয়েছি। আগত কোনো যাত্রীর মাধ্যমে যেন রোগটি ছড়িয়ে না পড়ে তার চেষ্টা করছি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, স্থলবন্দর, বিমানবন্দরসহ সব আন্তর্জাতিক বন্দরে স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এমপক্স শনাক্তকরণের জন্য রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ৫০০ কীট মজুদ করেছে। আরো কিটের সংস্থান করা হচ্ছে। পরে প্রয়োজন অনুযায়ী তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হবে। কীট ছাড়াও আরটিপিসিআরের (রিয়েল-টাইম রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ-পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন) মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষা করে রোগটি শনাক্ত করা যায়। কীট ছাড়াও হাসপাতালগুলো আরটিপিসিআর দিয়ে পরীক্ষা করতে পারবে। জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জন এবং উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে জনসচেতনতা তৈরিতে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বলা হয়েছে।
এমপক্স সম্পর্কে ডব্লিউএইচও বলছে, মাংকিপক্স ভাইরাস হলো অর্থোপক্স ভাইরাস। গুটিবসন্তের একই গোত্রীয় ভাইরাস হলেও এমপক্স কম ক্ষতিকারক। ১৯৮০ সালে গুটিবসন্ত নির্মূল করা হলেও মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোয় এমপক্স রয়ে যায়। ২০২২ সালের মে মাসের আগে আফ্রিকান অঞ্চলের বাইরে যেসব দেশে এ রোগ দেখা যায়নি, সেসব দেশেও রোগটি শনাক্ত হচ্ছে। এরই মধ্যে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে অন্তত পাঁচশর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শুরুতে প্রাণীর শরীর থেকে মানুষের মধ্যে এই রোগের সংক্রমণ হলেও এখন মানুষের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ছড়ায়। প্রাথমিক লক্ষণের মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, ফোলা, পিঠে ও পেশিতে ব্যথা। এমপক্সের রোগীর শরীরে জ্বর উঠলে গায়ে ফুসকুড়ি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এরপর ফুসকুড়িগুলো মুখ থেকে শুরু করে পায়ের তলদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হতে ১৪ থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সময় লাগে।
চলতি বছরে আফ্রিকান ইউনিয়নের দেশগুলোয় সাড়ে ১৭ হাজার মানুষের শরীরে এমপক্স শনাক্ত হয়েছে বলে গত বুধবার জানিয়েছে আফ্রিকা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)। তাদের তথ্য অনুযায়ী, বছরের শুরু থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত আফ্রিকায় ৫১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সংখ্যা ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় সংক্রমণের ক্ষেত্রে ১৬০ শতাংশ ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে ১৯ শতাংশ বেশি। প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুরা বেশি আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে এমপক্স শনাক্তের কোনো ইতিহাস নেই বলে জানিয়েছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও রোগতত্ত্ববিদ ডা. মুশতাক হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এ রোগ উদ্বেগজনক হারে ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশে এ রোগ এখনো দেখা যায়নি। তবে আফ্রিকা ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছে। এমপক্স একটি ভাইরাসজনিত রোগ। আফ্রিকার কঙ্গোতে এর প্রাদুর্ভাবের কারণ ছিল ক্লেড ১ ভাইরাস। তবে ইউরোপে ছড়িয়েছে ক্লেড ২ ভাইরাস। ক্লেড ২ ভাইরাসে মৃত্যুহার কম। ক্লেড ১ ধরনটিতে মৃত্যুহার বেশি।’
হাসপাতালের প্রস্তুতি শেষ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের (বিআইটিআইডি) পরিচালক ডা. মো. সাখাওয়াত উল্লাহ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসোলেশন প্রস্তুত করা হয়েছে। আশপাশের জেলায় এ রোগে সন্দেহভাজন বা কোনো রোগী পাওয়া গেলে তাদের চিকিৎসার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ানদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।’
নির্ধারিত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিলেটের হাসপাতালটিতে এ রোগীর জন্য ১০ শয্যার একটি ওয়ার্ড প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে দুটি আইসিইউ শয্যাও। কুর্মিটোলা জেনারেলে ছয় শয্যার আইসোলেশন, ১২ শয্যার ওয়ার্ড প্রস্তুত করা হয়েছে।
ঢাকা সংক্রামক ব্যধি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও সিনিয়র কনসালট্যান্ট (মেডিসিন) ডা. আরিফুল বাসার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে সব প্রস্তুতি শেষ করেছি। ১০ শয্যার আইসোলেশন ওয়ার্ডসহ এক শয্যার আইসিইউ সেটআপ করা হয়েছে।’