এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড: স্বল্পমূল্যে মানসম্পন্ন ওষুধের আস্থা

দেশের শতভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একমাত্র ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ইডিসিএল। ১৯৬২ সালে সরকারি ফার্মাসিউটিক্যাল গবেষণাগার হিসেবে এটির প্রতিষ্ঠা। ফার্মাসিউটিক্যালস উৎপাদন ইউনিট নামকরণ করা হয় ১৯৭৯ সালে। কোম্পানি আইনের অধীনে ১৯৮৩ সালে এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) নামে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয়।

মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদন করে তা সাশ্রয়ী মূল্যে সরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সরবরাহের লক্ষ্য নিয়ে গড়ে তোলা হয় ইডিসিএল। শুরু থেকে অদ্যাবধি প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত ওষুধ সারা দেশের সরকারি হাসপাতাল, সিভিল সার্জন অফিস, সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ছাড়াও জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) মতো অলাভজনক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হচ্ছে।

প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠানটি সরকারের ক্রয় ও বণ্টন সংস্থা হিসেবে কাজ করত। পরবর্তী সময়ে চিকিৎসাপণ্য উৎপাদন শুরু করে ইডিসিএল। বর্তমানে জনগণের চাহিদা অনুযায়ী সরকারকে ওষুধ সরবরাহ করছে প্রতিষ্ঠানটি। ওষুধ রফতানি করছে বিদেশেও।

৫৯ বছর বয়সী ইডিসিএল সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের চাহিদার ৮০ শতাংশ ও কমিউনিটি ক্লিনিকের চাহিদা শতভাগ ওষুধ সরবরাহ করছে। মোট উৎপাদনের ৭০ শতাংশ ওষুধ ইডিসিএল উৎপাদন করছে। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ ওষুধ চাহিদা ও প্রয়োজন অনুসারে ইডিসিএলের কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স এবং উৎপাদন বিভাগের কারিগরি দক্ষ ব্যক্তিদের সরাসরি তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে সব ধরনের গুণগত মান বজায় রেখে টোল ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের মাধ্যমে উৎপাদন করা হয়। গত দুই অর্থবছরে (২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০) মোট ১ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন করে ১ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকার বিক্রি করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দেয়া হয়েছে। গত অর্থবছরেও প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন করে তার ৯৫ শতাংশই বিক্রি হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বর্তমানে ঢাকাসহ সারা দেশে ইডিসিএলের ছয়টি প্লান্ট ও প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা ও বগুড়ার প্লান্টে ওষুধ উৎপাদন করা হয়। ১৯৮৩ সালে ঢাকায়, ১৯৮৫ সালে বগুড়া, ২০১০ সালে খুলনা ও টাঙ্গাইলের মধুপুর, ২০১১ সালে গোপালগঞ্জ এবং সর্বশেষ ২০১৩ সালে বগুড়ায় আরো একটি প্রকল্প চালু করা হয়। ২০১৬ সালের বন্যার পর পানি বিশুদ্ধ করার ট্যাবলেট উৎপাদন শুরু করে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি ৯৭ জেনেরিকের প্রায় ১৫০ ওষুধ উৎপাদন করছে।

ইডিসিএল জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি দেশীয় ও বৈদেশিক কাঁচামাল এবং মোড়কসামগ্রী ব্যবহারের মাধ্যমে মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদন করে। সরকারের চাহিদা অনুযায়ী অত্যাবশ্যকীয় ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরি করে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এজন্য রাজধানীর তেজগাঁওয়ের কারখানাটি মানিকগঞ্জে স্থানান্তর করা হবে। সেখানে ৩১ একর এলাকাজুড়ে প্লান্ট বসানো হবে, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছর শুরু হয়ে ২০২৬ সাল নাগাদ এটির কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

তেজগাঁওয়ে মূল প্লান্টটি ৬০ বছরের পুরনো হওয়ায় এটির মাধ্যমে কারেন্ট গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (সিজিএমপি) নীতিমালা অনুসরণ করা সম্ভব হচ্ছে না, যা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, ডব্লিউএইচওসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বীকৃত সনদ। এজন্য মানিকগঞ্জে এটিকে স্থানান্তর করে আরো আধুনিক ও যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে পাঁচটি নতুন ইউনিট চালু করা হবে। এর মধ্যে ট্যাবলেট, লাইফিলাইজড পাউডার, লিকুইড, ক্যাপসুল ও ড্রাই সিরাপ এবং স্টেরাইল উৎপাদনকারী ইউনিট স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে নতুন প্রকল্পটিতে। এছাড়া ইনজেকশন-জাতীয় ওষুধ প্রস্তুত করে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় সরকারকে সহযোগিতা করা ও বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করা যাবে।

দেশে ১৩টি রোগের জন্য বিভিন্ন বয়সী মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হয় ১১টি টিকা। ইউনিসেফ ও গ্যাভির মাধ্যমে এসব টিকা দেশে আমদানি করা হয়। তবে দেশেই সব ধরনের টিকা তৈরি করতে চায় সরকার। সে লক্ষ্যে গোপালগঞ্জে উন্নতমানের গবেষণাগার ও টিকা তৈরির কারখানা করা হচ্ছে। সাত একর জমিতে টিকার প্লান্ট প্রস্তুত করা হচ্ছে। প্লান্ট নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার এক-দেড় বছরের মধ্যে করোনার টিকা বোতলজাত ও তিন বছরের মধ্যে টিকা উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন ইডিসিএলের কর্মকর্তারা। এ লক্ষ্যে দুটি বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা কাজ করবেন।

ইডিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, রাষ্ট্রীয় ওষুধ উৎপাদনকারী এ প্রতিষ্ঠানের স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে আরো সময় লাগবে। তবে বেশ দ্রুততার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। এতে কয়েক বছরের মধ্যে সব ধরনের টিকা উৎপাদন করা যাবে। ফলে দেশ টিকা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। এতে করোনার টিকাও উৎপাদন করা যাবে। তেজগাঁওয়ের প্লান্ট মানিকগঞ্জে স্থানান্তর করা হলে সেখানে ভিটামিন ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল উৎপাদন করা যাবে। স্যালাইন উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

সরকারের চাহিদা অনুসারে ওষুধ সরবরাহ করা ইডিসিএলের প্রধান দায়িত্ব উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক ডা. এহসানুল কবির জগলুল বণিক বার্তাকে বলেন, ইডিসিএলের সক্ষমতা বাড়াতে আমরা দেশের বিভিন্ন স্থানে প্লান্ট স্থাপন করছি। ঢাকার প্লান্টটি মানিকগঞ্জে প্রতিস্থাপন করা হবে। এতে নতুন নতুন ওষুধ উৎপাদন করার সক্ষমতা তৈরি হবে। গোপালগঞ্জে সাত একর জমির ওপর টিকা উৎপাদনকারী প্লান্ট স্থাপন করা হবে। জমি অধিগ্রহণ শেষে প্লান্ট স্থাপন কার্যক্রম শুরু হবে। আগামী জানুয়ারির মধ্যে এ কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি। এর এক-দেড় বছরের মধ্যে বিদেশ থেকে করোনার টিকার কাঁচামাল এনে বোতলজাত করা হবে। কাঁচামাল আমদানিতে দু-তিনটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলছি আমরা।

ইডিসিএলের অন্যতম ইউনিট হিসেবে খুলনা এসেনসিয়াল ল্যাটেক্স প্রকল্প (কেইএলপি) নামে খুলনায় একটি কনডম কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটির উৎপাদনক্ষমতা ছিল বছরে ১৫ কোটি পিস। এখন এটির উৎপাদনক্ষমতা বছরে প্রায় ২৫ কোটি পিস। খুলনার প্রকল্পের অধীনে টাঙ্গাইলের মধুপুরে একটি ল্যাটেক্স প্রসেসিং প্লান্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে উন্নতমানের রাবারের কষ সংগ্রহের পর তা প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে খুলনা কেইএলপিতে সরবরাহ করা হয়। গোপালগঞ্জে ইডিসিএলের গোপালগঞ্জ প্লান্টে জন্মনিয়ন্ত্রক বড়ি ও ইনজেকশন উৎপাদন করা হয়। এটির একটি ইউনিটে আইভি ফ্লুইডও উৎপাদন করা হয়। এ প্লান্টে সব ধরনের টিকা উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

ওষুধ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ইডিসিএলের প্লান্টের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমান সরকার ইডিসিএলের প্লান্টের সংখ্যা বাড়িয়েছে। ঢাকায় যে প্লান্ট রয়েছে তা মানিকগঞ্জে নেয়া হচ্ছে। এতে সক্ষমতা বাড়বে। বৈশ্বিক যেসব মান নিশ্চিত করে ওষুধ উৎপাদন করতে হয় তা পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত করা যাবে। ওষুধের সংখ্যাও বাড়ানো হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ট্যাবলেট উৎপাদন করা হবে নতুন প্লান্টে।

ইডিসিএলকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, প্রতিষ্ঠানটিকে সর্বোচ্চভাবে অগ্রাধিকার দিয়েছে সরকার। গ্রামীণ স্বাস্থ্য অবকাঠামোর কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে দেশের সরকারি সব চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানকে ইডিসিএলই ওষুধ সরবরাহ করছে। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ উৎপাদনের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

Source: Bonik Barta

Share the Post: