ওয়াসার পানিতে লবণাক্ততা: সুপেয় পানির জন্য খুলনাবাসীর ভরসা এখনো গভীর নলকূপ

মহানগরী খুলনার জনসংখ্যা গত এক দশকে প্রায় চার লাখ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখে। এ সময়ের মধ্যে বেড়েছে নগরীর সীমানাও। তবে আয়তন ও জনসংখ্যায় বাড়লেও খুলনার মানুষের জন্য সুপেয় পানির সরবরাহের ব্যবস্থা করতে পারেনি ওয়াসা। নগরীর শতভাগ মানুষ এখনো পানীয় জলের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। এ বিপুল মানুষের পানীয় জলের জোগান দিতে গিয়ে প্রতি বছরই নিচে নামছে খুলনার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। ফলে বাড়ছে লবণাক্ততার পরিমাণ। কেবল ভূগর্ভস্থ পানিই নয়, শুষ্ক মৌসুমে ওয়াসার মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে পাইপলাইনে সরবরাহ করা পানিও লবণাক্ততার কারণে পানের উপযোগী থাকে না। এমনকি জীবাণু, দুর্গন্ধ ও ভারী ধাতুর উপস্থিতির কারণে এ পানি দৈনন্দিন কাজের জন্যও ব্যবহার করা যায় না।

৪৬ বর্গকিলোমিটার আয়তন ও ৩১টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত খুলনা সিটি করপোরেশনে শুষ্ক মৌসুমে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। ১৯৯০ সালে খুলনা সিটি করপোরেশন যাত্রার পর স্থানীয়দের দাবির মুখে ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ওয়াসা। নগরীর বাসিন্দাদের দৈনিক পানির চাহিদা প্রায় ২৪ কোটি লিটার। এর মধ্যে কেবল সাত কোটি লিটার সরবরাহ করে ওয়াসা। আর সে পানিও পানের অযোগ্য। মূলত নদী থেকে পানি সংগ্রহ ও ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের মাধ্যমে এ পানির সংস্থান করা হয়। তবে বছরের ছয় মাস নদীর পানিতেও লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে বেগ পেতে হয় ওয়াসাকে।

ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, মোট ৪৫টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে সিটি করপোরেশন এলাকায় পানি সরবরাহ করা হয়। শুষ্ক মৌসুমে সে পানিতে লবণের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা পানের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এ সমস্যার সমাধানে ২০১৩ সালে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ করে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে সুপেয় পানির সংস্থানের প্রকল্প শুরু করা হয়। এ প্রকল্পে ৫০ কিলোমিটারের বেশি দূরে অবস্থিত মধুমতী নদীর পানি সংগ্রহ করে তা শোধন করে পাইপলাইন দিয়ে শহরে আনা হয়।

তবে এ প্রকল্পে সমাধানের বদলে সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে। নগরীর বাসিন্দাদের অভিযোগ, শোধনের মাধ্যমে যে পানি শহরে সরবরাহ করা হয় তা লবণাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত। স্বাভাবিকভাবেই তা পানের অযোগ্য। খুলনা সিটি করপোরেশনের ১০টি ওয়ার্ডের বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ওয়াসার সরবরাহ করা পানি পানযোগ্য নয়। এ পানির স্বাদ গ্রহণমাত্রার চেয়ে বেশি লবণাক্ত। পানি থেকে দুর্গন্ধও পাওয়া যায়। ফলে চাহিদা মেটাতে নিজেদের ব্যবস্থাপনায় গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে ব্যবহার করেন বেশির ভাগ স্থানীয়রা। নগরীর প্রায় ৪০ শতাংশ বাসিন্দা নিজ ব্যবস্থাপনায় গভীর ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি সংগ্রহ করেন। নগরীতে ব্যক্তি মালিকানায় প্রায় ১৫ হাজার গভীর ও অগভীর নলকূপ রয়েছে। তবে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় আগের মতো পানি পাওয়া যাচ্ছে না। গত এক দশকে প্রায় তিন মিটারের বেশি নিচে নেমেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। কোথাও কোথাও পানির স্তর প্রায় ৩৮ ফুট নিচে নেমেছে।

খুলনা সুপেয় পানি আন্দোলন কমিটি জানিয়েছে, পরীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে বিভিন্ন ধরনের জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এছাড়া সোডিয়াম ক্লোরাইড বা লবণের পাশাপাশি ভারী ধাতুর উপস্থিতিও মিলেছে। দীর্ঘদিন ধরে এ পানি ব্যবহার করার ফলে ক্যানসার, কিডনি রোগ, হূদরোগসহ দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

মধুমতী নদীর পানি পরিশোধনের যে প্রকল্প সেখানে পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করা হয়নি বলে দাবি খুলনার সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন)। এ ধরনের সমীক্ষায় অন্তত ৫০ বছরের প্রভাবের বিষয়ে প্রাক্কলন করা থাকে। নদীর পানি কখন কোন অবস্থায় থাকবে সেসব তথ্যও এ সমীক্ষায় উল্লেখ থাকবে। পরিসংখ্যান বলছে, মধুমতী নদীর পানি আট মাস ব্যবহার উপযোগী থাকে। ফলে এ সময়ে পানি ব্যবহার করা সম্ভব। বাকি চার মাসের জন্য আগে থেকেই পানি সংরক্ষণ করতে হবে। তবে এ সংরক্ষণাগারটিও কার্যকরী নয়। ২০১১ সালে জাইকার ফিজিবিলিটি স্টাডির তথ্যে দেখা যায়, মধুমতী নদীর পানিতে উচ্চমাত্রার ক্লোরাইড রয়েছে। তবে সেখানে এটাও বলা হয়, প্রথাগত শোধনের মাধ্যমে এসব ভারী ধাতুর অপসারণ সম্ভব নয়। আবার পানির লবণাক্ততা দূর করতে কোনো ব্যবস্থাও প্রকল্পে রাখা হয়নি।

ওয়াসার মূল কাজ নগরীর মানুষকে সুপেয় পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা দেয়া। তবে ওয়াসা যে পানি দেয় তা পানযোগ্য নয় বলে জানান খুলনা সুজনের সাধারণ সম্পাদক ও খুলনা পরিবেশ রক্ষা মঞ্চের সভাপতি অ্যাডভোকেট কুদরত-ই-খুদা। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ওয়াসার পানি গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা হয়। নদীর পানি শোধনের পরও যদি তা খাওয়া না যায়, তবে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। খুলনার শতভাগ মানুষ ভূগর্ভস্থ পানি পান করছে। পাশাপাশি অন্যান্য কাজেও এ পানি ব্যবহার করা হয়। দেখা গেছে, যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হয় তার ২৫ শতাংশ পানের জন্য এবং বাকি পানি উন্নয়ন যেমন ভবন নির্মাণ, বাগান করা ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অতি ব্যবহারে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।

খুলনা ওয়াসার জরিপ অনুযায়ী, ২০২০ সালে খুলনা নগরের বিভিন্ন স্থানে পানির স্তর ছিল ২৮ থেকে ৩১ ফুটের মধ্যে। তবে গত বছর তা ৩৫ থেকে ৩৭ ফুটে নেমে এসেছে। এর মধ্যে নগরীর ফেরিঘাট এলাকার পানির স্তর সবচেয়ে বেশি নিচে নেমেছে। এ এলাকার পানি প্রায় সাড়ে ৩৮ ফুট নিচে নেমেছে।

পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ও লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে দুষছেন ওয়াসা ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের কর্মকর্তা। তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দিন দিন পানিতে লবণের পরিমাণ বাড়ছে।

পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছে জাতিসংঘ। চলতি বছর প্রকাশিত জাতিসংঘের বৈশ্বিক পানি উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০২২ ‘মেকিং দি ইনভিসিবল ভিসিবল’ বলছে, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের দিক দিয়ে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। বিশ্ববাসী যে পানি পান করছে, তার ৯৯ শতাংশই ভূগর্ভ থেকে সংগ্রহ করা হয়। তবে এ সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির অপব্যবহার হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানি ব্যবহার পরিকল্পিতভাবে হতে হবে। নগরীর কোনো কোনো এলাকার পানির স্তর ৩২ ফুটও নিচে নেমে গেছে। খুলনার দুদিকে ভৈরব নদ ও রূপসা নদী রয়েছে। মধ্যখানে ময়ূর নদ। এমন শহর পাওয়া খুব কঠিন। ময়ূর নদ কাজে লাগিয়ে সে পানি সংরক্ষণ করা গেলে বাসিন্দাদের ২৫ শতাংশের পানির সংস্থান হবে। যদিও চার বছর আগে ময়ূর নদসহ ২২টি খাল সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। সে ময়ূর নদ এখন ময়লার ভাগাড়, বাঁধ দিয়ে চলছে আবাসন নির্মাণের কাজ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মধুমতী নদী থেকে যে পরিমাণ খরচ করে খুলনা শহরে পানি আনা হচ্ছে, তা দিয়ে রূপসা ও ভৈরব নদ-নদীর পানি ব্যবহার করে নগরবাসীর প্রয়োজন মেটানো যায়। আবার খাল সংস্কারের নামে এর নিচে কংক্রিটের আস্তরণ দেয়া হলে সেটি ভূগর্ভে পানি রিচার্জের সুযোগ বন্ধ করে দেয়। যেটিও ভূগর্ভে পানি স্বল্পতা সৃষ্টির একটি কারণ।

তবে এতসব তথ্য-প্রমাণের পরও খুলনায় সরবরাহ করা পানি পানযোগ্য বলে দাবি করেছেন খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ৩৮ হাজার ২০০ পরিবারকে পানি সরবরাহ করছি। আমরা তাদের মধুমতী নদী থেকে পানি এনে দিচ্ছি। ৪৫টির মতো গভীর নলকূপের মাধ্যমে আমরা ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলন করে বাসিন্দাদের দিচ্ছি। প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের বেশি রয়েছে। নগরীতে আমরা প্রতিদিন সাত কোটি লিটার পানি সরবরাহ করছি। এতে গ্রাহকদের পূর্ণ চাহিদা পূরণ হচ্ছে। নতুন কেউ আবেদন করলে আমরা তাদের চাহিদা মেটাতে পারব। আমরা চেষ্টা করছি কেউ গভীর নলকূপ ব্যবহার না করে যেন আমাদের পানি ব্যবহার করে।

ওয়াসার পানির বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মো. আব্দুল্লাহ বলেন, যে সংস্থা বা সংগঠনগুলো ওয়াসার পানি ভালো নয় দাবি করছে তারা সত্য বলছে।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বণিক বার্তার খুলনা প্রতিনিধি শুভ্র শচীন)

Source: Bonik Barta

Share the Post: