ওষুধের দামে রোগীর হাঁসফাঁস

প্রতি মাসেই মায়ের জন্য উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদ্‌রোগের ওষুধ কেনেন সাভারের বাসিন্দা মতিউর রহমান। সঙ্গে কেনেন কিছু ক্যালসিয়াম ও ভিটামিনও। মায়ের ওষুধের পেছনে তিন মাস আগেই তাঁর মাসিক খরচ ছিল ৬ হাজার টাকা। ওষুধের দাম বাড়ার কারণে এখন সেই খরচ বেড়ে ৯ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। শুধু মতিউর নন, তাঁর মতো অসংখ্য মানুষের মাসের খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে ওষুধের দাম বাড়ায়, যদিও বাড়েনি আয়।

ওষুধের বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর থেকে হঠাৎ করেই প্রায় অর্ধশত জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি। দাম বাড়ার তালিকায় শীর্ষে আছে জ্বর, শ্বাসকষ্ট, স্নায়বিক সমস্যা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যাসিডিটি ও ব্যথানাশক ওষুধ। সরকারের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরও ভোক্তাদের বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা অনুযায়ী দাম বাড়ায় অনুমোদন দিচ্ছে।

সম্প্রতি দাম বেড়েছে এমন একটি ওষুধের নাম টোরাক্স। কিটোরোলাক ট্রোমেথামিন গোত্রের (জেনেরিক) ব্যথানাশক এই ওষুধটি উৎপাদন করে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। একটি প্যাকেটে ১০ মিলিগ্রামের ৫০টি ট্যাবলেট বাজারজাত করা হয়। গত আগস্টে উৎপাদন করা ওষুধটির এক প্যাকেটের দাম ছিল ৬০০ টাকা। এক মাসের ব্যবধানে গত সেপ্টেম্বরে উৎপাদিত টোরাক্স বাজারজাত হয়েছে ১ হাজার টাকায়। প্রতিটি ট্যাবলেটের জন্য ৮ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে ক্রেতাকে। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু ওষুধের দাম বেড়েছে। তবে এই বাড়ার হার কোনোক্রমেই ১০ শতাংশের বেশি নয়।

তবে বাজার ঘুরে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। ওষুধের দোকানি ও বিপণনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দু-একটি ওষুধ ছাড়া সব ওষুধের দামই বেড়েছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ। তাঁরা জানান, এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালসের

টেট্রাসল ২৫ শতাংশ সলিউশনের (৩০ এমএল) বোতলের দাম সম্প্রতি ৬৮ টাকা থেকে বেড়ে ১২৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সে হিসাবে চুলকানির ওষুধটির দাম ৮৪ শতাংশ বেড়েছে।

দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনক ফুসফুসের রোগ বা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি)-এর জন্য ডক্সোফাইলিন গোত্রের ওষুধ ‘ডক্সোভেন’ ট্যাবলেট উৎপাদন করে বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস। ২০০ মিলিগ্রামের এক প্যাকেট ডক্সোভেন ট্যাবলেটের দাম আগে ছিল ৬৫০ টাকা, এখন সেটি ৮০০ টাকা করা হয়েছে। শতাংশের হিসাবে দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশ।

শ্বাসকষ্টের জন্য ব্যবহৃত উইন্ডেল প্লাস রেস্পিরেটর সলিউশনের ৩ এমএল বোতলের দাম ২০ টাকা থেকে বেড়ে ২৫ টাকা হয়েছে। ইনসেপ্টার ফার্মার এই ওষুধের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ। একই প্রতিষ্ঠানের অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের বুটিকট (২ এমএল) নেবুলাইজার সাসপেনশন ওষুধের দাম বেড়েছে ১৩ শতাংশ।

রাজধানীর মিরপুরের একটি ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী আজকের পত্রিকাকে জানান, বিভিন্ন প্রকার ওষুধের দাম বেড়েছে। গত তিন বছরে বিভিন্ন দফায় সব প্রতিষ্ঠানই ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। কোনো কোনো ওষুধের ক্ষেত্রে একাধিক বার দাম বাড়ানো হয়েছে। যাঁরা নিয়মিত ওষুধ কেনেন, তাঁরা মাসের ব্যবধানে এসে দেখছেন, ৫০ টাকার ওষুধ ১০০ টাকা হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, গত তিন মাসে যেসব ওষুধের দাম বাড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তার সংখ্যা ১০টির বেশি হবে না। এখনো অন্তত ২০টি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অর্ধশত ওষুধের দাম বাড়ার জন্য কাগজ জমা দিয়ে রেখেছে। তবে এই মুহূর্তে আর দাম না বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আসরাফ হোসেন বলেন, ‘একই জেনেরিকের ওষুধ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করে। এসব ওষুধের দামের পার্থক্য ছিল, তা সমন্বয় করা হয়েছে। এখনো বিভিন্ন ওষুধের দাম বাড়ার জন্য ফার্মাসিউটিক্যালসগুলো আবেদন করেছে। তবে আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, এখন আর কোনো ওষুধের দাম বাড়ানো হবে না। আর ১১৭টি ওষুধের দাম আমরা নির্ধারণ করি। বাকি ওষুধের ক্ষেত্রে কেউ চাইলেই দাম বাড়াতে পারে এমনটি নয়। কেননা উৎপাদন খরচ থেকে শুরু করে সকল কাগজপত্র আমাদের দেখাতে হয়। দাম বাড়াতে এলে তা যাচাই-বাছাই করার সুযোগ আমাদের রয়েছে।’

ডায়াবেটিক রোগীদের ইনসুলিন হিউমুলিন এন ইনজেকশন কুইকপেন (৩ মিলি) তৈরি করে ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সিজ (বিডি) লিমিটেড। এই ইনজেকশন এক প্যাকের (৫টি) দাম ৩ শতাংশ বেড়ে ৩ হাজার ৬০০ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া ইনজেকশন হিউমুলিন আর কুইকপেনের (৩ মিলি ) দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৮৯০ টাকা করা হয়েছে। অপসোনিন ফার্মার তৈরি অ্যাসিডিটির ওষুধ ফিনিক্স (২০ এমজি)-এর দাম ১৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে।

একইভাবে বেড়েছে উচ্চ রক্তচাপের কাভারসিল ও বাইজোরানের দাম। ঠান্ডা-জ্বরের ওষুধের দামও সমানুপাতিক হারে বেড়েছে। ২০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়েছে এসব ওষুধের। বিভিন্ন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের ক্ষেত্রেও দাম বাড়ানো হয়েছে। কোনোটির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ আবার কোনোটির ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়।

ওষুধের দাম বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কয়েকটি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অন্তত চারজন দাবি করেন, ওষুধের কাঁচামাল অধিকাংশই চীন ও ভারত থেকে আমদানি করা হয়। কিছু কাঁচামাল ইতালি, পোল্যান্ডসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা হয়। যে ফর্ম বা সংস্করণেই আসুক না কেন, সব কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে কাস্টমস শুল্ক দিতে হয়। হাতে গোনা কয়েকটি ওষুধের কাঁচামালের শুল্কছাড়ের সুবিধা রয়েছে। উৎপাদন খরচের সঙ্গে সমন্বয় করতে গিয়ে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়, যা ১০ থেকে ২৯ শতাংশের বেশি নয় বলে দাবি তাদের।

এ বিষয়ে বীকন ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপক (পণ্য ব্যবস্থাপনা) মাসুদ বিল্লাহ বলেন, গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এতে উৎপাদন খরচ ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। ওষুধের প্রায় শতভাগ কাঁচামাল আদমানিনির্ভর। উৎপাদনের পর ওষুধের দোকানকেও লাভের সুযোগ দিতে হয়। এমন পর্যায়ে গেছে, তাতে কোনো ওষুধে লাভ খরচের মার্জিনে গিয়ে দাঁড়ায়। মিনিমাম প্রফিট না থাকলে উৎপাদনও বন্ধ করে দিতে হয়।

ওষুধের দাম বাড়ানো ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছেমতো করতে পারে না বলে দাবি করেন বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এম শফিউজ্জামান। তিনি বলেন, ডলারের দাম, কাঁচামাল আমদানি খরচ, উৎপাদন খরচের সঙ্গে সমন্বয় করতে হলে দাম সামান্য বাড়াতে হয়। যেসব ওষুধের দাম ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ বাড়ার কথা বলেছেন, তা হয়তো ১০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে বাড়েনি। এখন উপায় না থাকায় বাড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। দাম বাড়াতে বললেও যৌক্তিক কারণ না দেখাতে পারলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর অনুমোদন দেয় না।

তবে স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, যে পণ্যের চাহিদা বেশি, তার দাম কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু যেসব ওষুধ বেশি বিক্রি হয় বা চাহিদা বেশি রয়েছে, তার দাম কমেনি। উৎপাদন খরচ বাড়লেও তা নিশ্চয়ই ৫০ শতাংশ বাড়েনি। কিন্তু ওষুধের দাম তার চেয়েও বেশি বাড়ানো হচ্ছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে গিয়ে মানুষের আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার (নিজ পকেট থেকে বাড়তি ব্যয়) বেড়েছে। এর বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে ওষুধে। বাংলাদেশে ৭০ শতাংশের ওপর আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার। এই ব্যয় কমাতে হলে ওষুধের ব্যয় কমাতে হবে। উৎপাদন খরচ বাড়তেই পারে, তবে তাতে দাম কত বাড়বে? মেডিসিন মানুষকে কিনতেই হয়। আয় বাড়েনি তবে ওষুধের ব্যয় বাড়লে অন্যান্য খাবারের খরচ কমিয়ে দিতে মানুষ বাধ্য হয়। এতে দেখা যায় মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে এবং অসুস্থই থেকে যায়।’

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশীয় চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। আর ইউরোপ ও আমেরিকার অঞ্চলসহ সারা বিশ্বের ১৫৭টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত ওষুধ। সর্বশেষ হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুমোদিত রপ্তানি আয় ৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি। দেশ ২২৯টি চালু অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানসহ ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথিক ও হারবাল ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৭৩৩টি। অ্যালোপ্যাথিক প্রায় ৩ হাজার জেনেরিকের ৩৭ হাজার ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে দেশে।

ওষুধের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকরী ভূমিকা নেই বলে জানিয়েছেন ওষুধ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, দেশে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের যে তালিকায় ২১৯টি ওষুধ রয়েছে, এর মধ্যে ১১৭টি ওষুধের দাম ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নির্ধারণ করে দেয়। ১১৭টি ওষুধের মধ্যে ৫৩টি ওষুধের দাম দুই বছর আগে বাড়িয়েছিল সরকার। বাকি অত্যাবশ্যকীয় এবং সব ধরনের ওষুধের ক্ষেত্রেই উৎপাদক প্রতিষ্ঠান যে দামে বাজারজাত করতে চায়, তাতে অনুমোদন দেয় অধিদপ্তর। এদিকে অত্যাবশ্যকীয় তালিকার সব ওষুধ উৎপাদনের জন্য দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে ওসব ওষুধে লাভের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি অজুহাত দেখিয়ে বেশির ভাগই প্রস্তুত করে না প্রতিষ্ঠানগুলো।

Share the Post: