শরীরে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা কতটুকু, তা বুঝতে অ্যান্টিবডি টেস্টের প্রয়োজন পড়ে। একই সঙ্গে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা মানুষের শরীরে কোন পর্যায়ের প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করল তা নিরীক্ষণ করতেও পরীক্ষাটি জরুরি, এমনটি বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে গত জানুয়ারিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পরও দেশে শুরু হয়নি অ্যান্টিবডি টেস্ট। নির্ধারণ হয়নি পরীক্ষার কিট ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম। বিষয়টি এক মাসের বেশি সময় ধরে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে আটকে রয়েছে। গত বুধবার ৩৫ দিন পর আবারো ঔষধ প্রশাসনকে চিঠি দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত জানুয়ারিতে অ্যান্টিবডি পরীক্ষার জন্য নীতিমালার অনুমোদন দেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। অনুমোদন দেয়া হয় দীর্ঘ বিতর্কের পর। মন্ত্রণালয় থেকে গত ১৮ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অনুমোদনের চিঠি আসে। এরপর ২৪ মার্চ পরীক্ষার কিট ও দাম নির্ধারণের জন্য ঔষধ প্রশাসনকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়। এক মাসের বেশি সময় ধরে ঔষধ প্রশাসনের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে গত ২৮ এপ্রিল আবার অনুরোধের চিঠি পাঠান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা।
চিঠিতে অ্যান্টিবডি টেস্টের জন্য কিট ও মূল্য নির্ধারণের জন্য তাগিদ দেয়া হয়। বলা হয়, টেস্ট কিটস ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জামের অনুমোদন (অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি টেস্ট) ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কর্তৃক হওয়া প্রয়োজন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অ্যান্টিবডি টেস্টের জন্য ব্যবহূত কিট অনুমোদন দেয়া যায় কিনা, তা বিশ্লেষণ এবং বর্তমান কভিড-১৯ মহামারীর ঊর্ধ্বগামী পরিস্থিতি মোকাবেলায় অ্যান্টিবডি টেস্টের ব্যবহার সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে শুরু করার ক্ষেত্রে কোন কোন অ্যান্টিবডি কিট ব্যবহার করা যায়, তার তালিকা ও মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুনরায় অনুরোধ করা হলো।
জানা যায়, শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ হলে এর বিরুদ্ধে লড়তে শরীরই এক পর্যায়ে প্রতিরোধী ব্যবস্থা তৈরি করে, যাকে অ্যান্টিবডি বলা হয়। অ্যান্টিবডির কাছে ভাইরাস পরাজিত হলে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন। শরীরে নির্দিষ্ট কোনো রোগের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা, রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে তা স্বল্প সময়ে জানা যায় অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে। কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার রক্তে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে ৫-১০ দিন সময় লাগতে পারে। ফলে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার আগে র্যাপিড কিটে নমুনা পরীক্ষা করা হলে ফলাফল নেগেটিভ হবে। শরীরে ভাইরাস থাকলেও এ পরীক্ষায় তা ধরা পড়বে না। এসব বিবেচনা করে গত বছর কভিড-১৯ মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি অ্যান্টিবডি পরীক্ষা চালুর পরামর্শ দেয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যান্টিবডি টেস্ট করা হয় গবেষণার কারণে এবং করোনায় আক্রান্তের পর ব্যক্তির শরীর কতটুকু প্রতিরোধী তা জানার জন্য। টিকা দেয়ার আগে অ্যান্টিবডি টেস্ট চালু করা দরকার ছিল। এতে যাদের শরীরে আগেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে তাদের বাদ দিয়ে বাকিদের টিকা দেয়া যেত। ফলে টিকার অপচয় রোধ করা যেত।
প্লাজমা দেয়ার ক্ষেত্রেও অ্যান্টিবডি টেস্ট গুরুত্বপূর্ণ। অ্যান্টিবডি টেস্ট না করে প্লাজমা দেয়া যুক্তিসংগত নয় বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ফার্মাকোলজি সোসাইটির সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর অনেকের শরীরে প্রতিরোধ সক্ষমতার সৃষ্টি হয়। যার শরীরে বেশি হয় তিনি অন্য আক্রান্তকে প্লাজমা দিয়ে সাহায্য করতে পারেন। এক্ষেত্রে জানতে হবে যিনি দিচ্ছেন তার প্রতিরোধক্ষমতা কেমন। কিন্তু যদি আপনি না জানেন, যিনি প্লাজমা দিচ্ছেন তিনি কতটুকু প্রতিরোধী সক্ষমতার অধিকারী তাহলে তো হবে না। এ কিটের অনুমোদন দেয়া বেশি সময়সাপেক্ষ নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, কোন কিটস ব্যবহার হবে এবং মূল্য কত হবে—এগুলো ঠিক হলে পরীক্ষার অনুমতি দেয়া হবে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর), আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গবেষণার কাজে অ্যান্টিবডি টেস্ট করেছে। তবে কিটের অনুমোদন না হওয়ায় ব্যক্তি পর্যায়ে এ পরীক্ষা হচ্ছে না কোথাও। কিটের অনুমোদন পাওয়া গেলে দেশের জেলা হাসপাতালসহ বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোয় অ্যান্টিবডি পরীক্ষা শুরু করা হবে। তবে সরকারি সব হাসপাতালে নয়। যেসব হাসপাতালে আরটি-পিসিআর টেস্ট হয় এবং কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল তাদেরই অনুমতি দেয়া হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, পরামর্শক কমিটি যখন এ বিষয়ে নীতিমালা করে তখন সেখানে উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে এটা ব্যক্তি পর্যায়ে নয়। গবেষণার জন্য কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান অ্যান্টিবডি টেস্ট করতে চাইলে তা ঠিক আছে। শরীরে অ্যান্টিবডি আছে কিনা এটা ব্যক্তি জেনে কী করবে। বিশ্বে বিষয়টি সর্বস্বীকৃত নয়।