দেশের সব বয়সী মানুষের মধ্যেই অনিদ্রা ও ঘুমস্বল্পতা বাড়িয়েছে কভিড মহামারী। রোগ নিয়ে ভীতিসহ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায়ও দেখা গিয়েছে, কভিডের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর থেকে দেশের সব বয়সী মানুষের মধ্যে অনিদ্রা ও ঘুমস্বল্পতা বেড়েছে। ঝুঁকিতে পড়েছে তাদের দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্য।
অনলাইন জরিপের ভিত্তিতে পরিচালিত এ গবেষণার আওতায় ছিলেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রায় এক হাজার মানুষ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ, শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ, এক্সিলেন্স ইন পাবলিক হেলথ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত বিশেষজ্ঞ গবেষণাটি পরিচালনা করেন। তথ্যদাতাদের ঘুমের মান নির্ণয়ের জন্য পিডসবার্গ স্লিপ কোয়ালিটি ইনডেক্স ব্যবহার করা হয়। ‘ইনভেস্টিগেটিং পুওর স্লিপ কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটেড ফ্যাক্টরস ডিউরিং দ্য কভিড-১৯ প্যানডেমিক: আ পপুলেশন বেসড সার্ভে ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধ গত মাসে ফ্রন্টিয়ার্স ইন পাবলিক হেলথ নামের জার্নালে প্রকাশ পেয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, কভিডের প্রাদুর্ভাবের পর জরিপের আওতাধীন ব্যক্তিদের মধ্যে অনিদ্রা ও ঘুমস্বল্পতায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫৫ শতাংশ।
কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে পরোক্ষ যোগাযোগ, মহামারীতে পারিবারিক আয় কমে যাওয়া, সংক্রমণের ভয়সহ নানাবিধ কারণে কভিডকালে অনিদ্রা ও ঘুমস্বল্পতার প্রকোপ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। বিশেষ করে পঁচিশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে এর প্রভাব দেখা গিয়েছে বেশি। গবেষণায় উঠে আসে, নারীদের মধ্যেই এ অনিদ্রা ও ঘুমস্বল্পতার প্রকোপ তুলনামূলক বেশি। মহামারীর প্রাদুর্ভাবজনিত অনিদ্রার প্রভাব দেখা গিয়েছে গবেষণার আওতাধীন ৬৩ শতাংশ নারীর মধ্যে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা পরিবারের সদস্যদের দেখাশোনা ও গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত ছিলেন। লকডাউনের সময় শিশু ও বৃদ্ধসহ পরিবারের সদস্যদের অতিরিক্ত যত্ন নিতে গিয়ে তাদের ঘুমের মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটেছে।
চলতি মহামারীর শুরুতে রোগ নিয়ে ভীতি তৈরির সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা মানুষের সুস্থাস্থ্যের জন্য পর্যাপ্ত ঘুমের মতো অপরিহার্য বিষয়কে প্রভাবিত করেছে। এতে দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষই বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন বলে সাম্প্রতিক প্রকাশিত একটি গবেষণায় উঠে এসেছে।
যারা বিভিন্ন ধরনের অসংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছেন, তারা ঘুমের সমস্যায় বেশি পড়েছেন। এতে তাদের মধ্যে নতুন করে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এ ধরনের মানুষের মধ্যে ৮৮ শতাংশের ক্ষেত্রে ঘুমের জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। একইভাবে মাঝারি ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারীদের মধ্যেও পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব রয়েছে।
গৃহস্থালির আয় কমে যাওয়ার ফলেও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঘুমের মাত্রা কমেছে। মহামারীর কারণে যেসব পরিবারের আয় কমেছে, সেসব পরিবারের সদস্যদের ৫৭ শতাংশ ঘুমের সমস্যায় পড়েছেন। একই সঙ্গে আয় না কমলেও এ সমস্যায় পড়েছেন ৪৯ শতাংশ মানুষ। এর পেছনে আবার অন্য কারণগুলো প্রভাব ফেলেছে। মূলত কভিড-১৯ সংক্রমিত ব্যক্তিদের সঙ্গে পরোক্ষ যোগাযোগ, সরকার ঘোষিত কড়াকড়ি আরোপ ও সংক্রমণের ভয়েও ঘুমের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি মানসিক চাপ, উদ্বেগ, বিষণ্নতা, আর্থিক ক্ষতি, যোগাযোগ কমে যাওয়ার মতো অবস্থার ফলেও গবেষণায় অংশ নেয়া ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত ঘুম হয়নি। এতে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, পর্যাপ্ত ও ভালো ঘুম মানুষের শরীর ও মনের জন্য অপরিহার্য একটি বিষয়। সুস্বাস্থ্যের জন্য ঘুম যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এর ঘাটতি হলে স্বাস্থ্যগত সমস্যাও সৃষ্টি হয়। অপর্যাপ্ত ঘুম মানুষকে স্থূল করে তোলে। একইভাবে কার্ডিওভাসকুলার জটিলতা, মেজাজের ওপর বিরূপ প্রভাব ও মানসিক বিপর্যয়ের মতো অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। অপর্যাপ্ত ঘুম বর্তমান বিশ্বে জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে যে ১৫টি কারণে বেশি মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে সাতটির পেছনে রয়েছে অপর্যাপ্ত ঘুম। করোনা মহামারী শুধু নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় দরিদ্রতা বাড়ায়নি, বরং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাও সৃষ্টি করেছে। মহামারীতে বেড়েছে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও ওষুধ প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা।
সংশ্লিষ্ট গবেষণার গবেষক ও শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ডা. কামরুল আহসান খান বণিক বার্তাকে বলেন, অনেক কারণে ঘুম না হওয়ার মতো সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। আমরা এ গবেষণায় শুধু করোনা মহামারীতে যেসব কারণে এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো তুলে আনার চেষ্টা করেছি। অপর্যাপ্ত ঘুমের কারণে গ্যাস্ট্রিক, উচ্চরক্তচাপ, কার্ডিওভাসকুলার সমস্যা, স্ট্রোক, হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিসসহ নানা স্বাস্থ্যগত জটিলতা সৃষ্টি হয়। অনিদ্রার কারণে শরীরে থাকা অন্যান্য রোগ বেড়ে যায়।
আরেক গবেষক সাইফুল ইসলাম বলেন, মূলত মহামারীকালে যেসব কারণে দেশের মানুষের ভালো ঘুম হয়নি, সেগুলোই তুলে আনতে চেষ্টা করা হয়েছে। অর্থাৎ ঘুম না হওয়ার পেছনে প্রভাবক হিসেবে কী কী ছিল তা খতিয়ে দেখা হয়েছে এ গবেষণায়।
এ মহামারীতে একটা বড় সময় ভালো ঘুম না হওয়ার সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকির জন্য দায়ী হতে পারে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, করোনা মহামারীর মধ্যে মানুষের স্বাস্থ্যগত যেসব সমস্যা তৈরি হয়েছে তা দীর্ঘদিন স্থায়ী হচ্ছে। ঘুমের সমস্যা দূর করতে হলে মূলত এর প্রভাবকগুলোর অনুসন্ধান করতে হবে। মূলত আর্থসামাজিক সমস্যার কারণে অপর্যাপ্ত ঘুম হচ্ছে। যারা এ সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের কাউন্সেলিং করা প্রয়োজন বলে মনে করেন এ চিকিৎসক। ঘুম হচ্ছে না বলে শুধু ওষুধ দিলে লাভ হবে না। ঘুম না হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করে তার সমাধান করতে হবে।
ডা. আবু জামিল ফয়সালের মতে, এখন কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যা নিয়ে কেউ চিকিৎসকের কাছে গেলে আগে জানতে হবে ওই রোগীর ঘুম ও মানসিক স্থিতি কেমন অবস্থায় আছেন। মানসিক বিষণ্নতা বা অপর্যাপ্ত ঘুমের সমস্যা নির্ণয় হলে তাকে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাতে হবে। কারণ পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব থাকলে শারীরিক অন্যান্য সমস্যা বা রোগ তেমন একটা ভালো করা যাবে না। চিকিৎসার প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির অপর্যাপ্ত ঘুমের বিষয়টি বিবেচনায় এনে তার সমাধান আগে করতে হবে বলে মনে করেন এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।