বেসরকারি চাকরিজীবী আরিফিন শাকিলের (ছদ্মনাম) ষাটোর্ধ্ব মা করোনা জটিলতা নিয়ে গত জুনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাওয়াসহ শারীরিক জটিলতার মাত্রা বাড়লে তাকে রাজধানী ঢাকায় আনা হয়। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) দুই সপ্তাহ ভর্তি থাকেন এ নারী। এ সময় উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যায়। একই সঙ্গে ফুসফুসের প্রদাহ কমানোর লক্ষ্যে তার শরীরে টসিলিজুমাব জেনেরিকের একটেমরা প্রয়োগ করা হয়। এরপর জটিলতা আরো বাড়লে শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচাতে পারেননি চিকিৎসকরা।
দেশে দ্বিতীয় পর্যায়ে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে গত এপ্রিলে টসিলিজুমাব জেনেরিকের একটেমরা ইনজেকশনের চাহিদা বেড়ে যায়। আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তা প্রয়োগ করেন চিকিৎসকরা। তবে ওষুধটির যথাযথ কার্যকারিতার বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সতর্কতাহীন প্রয়োগে রোগীর শারীরিক জটিলতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কার বিষয়টি বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে টসিলিজুমাব ব্যাপকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে। তবে প্রয়োগ-পরবর্তী কার্যকারিতা নিয়ে কোনো পর্যবেক্ষণ নেই। ফলে অনেকটা ধারণার ওপরে ওষুধটি প্রয়োগ করা হচ্ছে।
করোনায় আক্রান্ত সংকটাপন্ন রোগীদের ওপর চার পর্যায়ে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পর ওষুধটিকে গত জুনে কভিড-১৯ পজিটিভ রোগীর শরীরে প্রয়োগের অনুমতি দেয় যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ)। তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে তারা বেশ কয়েকটি শর্ত দেয়।
এফডিএ বলছে, শরীরে প্রদাহ কমাতে শুধু হাসপাতালে ভর্তি জটিল করোনা রোগীদের একটেমরা ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ওষুধটি করোনার চিকিৎসা নয়। যেসব রোগীর উচ্চমাত্রার অক্সিজেন প্রবাহ প্রয়োজন, আইসিইউতে ভেন্টিলেশনে যান, ফুসফুস চরম মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্তসহ নানা শারীরিক জটিলতা রয়েছে, তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হিসেবে ইনজেকশনটি কাজ করে। তবে ওষুধটি প্রয়োগে সম্ভাব্য উপকারিতা ও ক্ষতি বিবেচনায় আনতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. ফজলে রাব্বি চৌধুরী দীর্ঘদিন করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছেন। তিনি বণিক বার্তাকে জানান, নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অনেক ব্যক্তির ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই সঙ্গে অক্সিজেন নেয়ার ক্ষমতা কমে যায়। তখন উচ্চমাত্রার অক্সিজেন ও ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন হয়। সে সময় সহায়ক চিকিৎসা হিসেবে একটেমরা প্রয়োগ করা হয়। তবে একটেমরা প্রয়োগে রোগীর অবস্থার উন্নতি না-ও হতে পারে। মূলত বেসরকারি হাসপাতালে ওষুধটির প্রয়োগ বেশি। কিছুটা অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রয়োগ করা হয়।
গত এপ্রিলে দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত ‘টসিলিজুমাব ইন হসপিটালাইজ পেশেন্টস উইথ সিভিয়ার কভিড-১৯ ফেনোমেনা’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে টেসিলিজুমাব জেনেরিকের ওষুধ প্রয়োগে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ৬২টি হাসপাতালে সংকটাপন্ন ২৯৫ জন করোনা রোগীর শরীরে ওষুধটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়।
গবেষণাটি বলছে, করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে সংকটাপন্ন ১৫ শতাংশকে আইসিইউতে উচ্চমাত্রার অক্সিজেন প্রবাহ দিতে হয়। মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশন দিয়ে তাদের কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়। টসিলিজুমাব অতিমাত্রার জ্বর, অক্সিজেন ও যান্ত্রিক বায়ুচলাচল (মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশন) এবং ফুসফুসের প্রদাহ কমাতে প্রয়োগ করা হয়।
টসিলিজুমাব প্রয়োগকৃত ৩৫ শতাংশ রোগীর শরীরে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। আর মারা গেছেন ২০ শতাংশ সংকটাপন্ন রোগী। ট্রায়াল চলার ২৮তম দিনে তারা মারা যান। অন্য গোত্রের ওষুধের চেয়ে টসিলিজুমাব খুব বেশি কার্যকর বলা যাচ্ছে না বলেও গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। টসিলিজুমাব মৃত্যু কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেনি। যদিও মৃত্যুর বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল না।
বাংলাদেশের মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় আক্রান্ত অনেকের শরীরে বিভিন্ন ধরনের তীব্র ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের (পচন ও নানা ধরনের প্রদাহজনিত রোগ) মাত্রা বেশি, যা ইন্টারলিউকিন-৬ (আইএল-৬) নামে পরিচিত। কভিড-১৯ আক্রান্ত অনেক রোগীর ক্ষেত্রে প্রতিরোধ সক্ষমতা কমে গিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। একে সাইটোকিন রিলিজ সিনড্রোম (সিআরএস) বলা হয়। ইন্টারলিউকিন-৬ সিআরএসের ক্ষেত্রে শ্বাস-প্রশ্বাসে অস্বাভাবিকতা তৈরি করে। যেসব কভিড-১৯ রোগীর ইন্টারলিউকিন-৬-এর মাত্রা বেশি, তদের মৃত্যুহার বেশি। এসব ক্ষেত্রে টেসিলিজুমাব গোত্রের একটেমরা ওষুধ প্রয়োগ করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটেমরা ইনজেকশন সুইজারল্যান্ডের ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ‘রোস’ উৎপাদন করে। বাংলাদেশে রেডিয়েন্ট বিজনেস কনসোর্টিয়াম ওষুধটি আমদানি করে। তিন ধরনের ভায়ালে ৮০ মিলিগ্রাম, ২০০ মিলিগ্রাম ও ৪০০ মিলিগ্রামের ওষুধটির মূল্য ১২ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। চাহিদা কয়েক গুণ বেশি হওয়ার কারণে এ ওষুধের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে ১ লাখ টাকার বেশিতেও কেউ কেউ কিনছেন বলে জানা গেছে।
করোনার আগে দেশে বছরে প্রায় ১০০ ভায়াল আমদানি হয়েছে। ক্রয়ক্ষমতা না থাকার কারণে সব রোগী ওষুধটি নিতে পারেন না। গত বছরের মার্চে চীন প্রথম করোনা রোগীদের ওষুধটি প্রয়োগ করে।
চিকিৎসকরা বলছেন, একটেমরা প্রয়োগের কারণে রোগীর শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার হার কম নাকি বেশি তা বাংলাদেশে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে না। রোগীর অবস্থা পর্যালোচনা করে ওষুধটি প্রয়োগ করতে হয়। আইসিইউতে ভর্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রয়োগ করা গেলে রোগীর অবস্থার উন্নতি হতে পারে। মূলত এক ডোজ প্রয়োগ করার নিয়ম থাকলেও কারো ক্ষেত্রে দুই ডোজ প্রয়োজন হতে পারে। বায়োটেক প্রযুক্তিতে ওষুধটি উৎপাদন, বিতরণ, সংরক্ষণ জটিল ও সময়সাপেক্ষ। ২ থেকে ৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় এ ওষুধ সংরক্ষণ করতে হয়। সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ ও পরিবহন না করে প্রয়োগ করলে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।
দেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর ওষুধের অপপ্রয়োগ হয়। করোনায় আক্রান্তদের জন্য নির্দিষ্ট ওষুধ না থাকায় বিষয়টি নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ‘ন্যাশনাল গাইডলাইন অন ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট অব কভিড-১৯’ প্রণয়ন করে সরকার। এতে টসিলিজুমাব ওষুধ প্রয়োগের বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। উপযোগিতা, সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং খরচ বিবেচনা করে আইসিইউতে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সীদের মধ্যে যাদের মিনিটে ৩০ লিটারের বেশি অক্সিজেন দেয়া হয়, তাদের ওপর প্রয়োগ করতে বলা হয়েছে। তবে এক ডোজ প্রয়োগের পর বিবেচনাপূর্বক দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ করা যাবে। টসিলিজুমাব প্রয়োগের বিষয়ে কয়েকটি সাবধানতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে।
গাইডলাইন তৈরিতে অংশ নিয়েছেন ঢাকা সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আরিফুল বাসার। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ওষুধটি প্রয়োগে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় উপকারিতা ও ক্ষতির বিষয়টি বলা হয়েছে। তবে সর্বোচ্চ সতর্কতায় প্রয়োগের ফলে ওষুধটির কার্যকারিতাও রয়েছে।’
বাংলাদেশ রিউমাটোলজি সোসাইটির সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একটেমরা উপকারী নয়, তা ঢালাওভাবে বলা যাবে না। তবে পুরো পৃথিবীতে এর অপপ্রয়োগ হচ্ছে। দেশের কিছু বেসরকারি হাসপাতাল ওষুধটির অপপ্রয়োগ করছে। বাংলাদেশে একটেমরা প্রয়োগের লাভ-ক্ষতির পর্যবেক্ষণ নেই। সরকারের গাইডলাইন থাকলেও প্রয়োগকৃত রোগীর মৃত্যু ওষুধটির কারণে হচ্ছে কিনা তা নিরূপণের ব্যবস্থা নেই।’