দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য প্রাথমিক ও প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য গত দুই দশকেরও বেশি সময় কাজ করছে কমিউনিটি ক্লিনিক। সময়ের সঙ্গে দেশব্যাপী এ ক্লিনিকের সংখ্যা বাড়িয়েছে সরকার। এতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছেছে তৃণমূল মানুষের দোরগোড়ায়, কিন্তু সে অনুযায়ী সেবাগ্রহীতার হার বাড়েনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও সুবিধার অভাবের কারণেই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় সেবা গ্রহণের হার বাড়ছে না।
সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো দেশের গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা খাতে পরিষেবা গ্রহণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেনি। বিশেষ করে বাড়ির কাছের এসব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্থানীয় নারী ও শিশুদের সেবা গ্রহণে আগ্রহী করতে পারেনি। মূলত নিম্নমানের পরিষেবা এবং প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা না থাকার কারণেই এসব কেন্দ্রের প্রতি আগ্রহী হয় না স্থানীয় মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একাডেমিক জার্নাল উইলির গত নভেম্বর সংখ্যায় ‘প্রক্সিমিটি টু হেলথকেয়ার সেন্টারস অ্যান্ড সার্ভিস ইউজ: দ্য কেস অব কমিউনিটি ক্লিনিকস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের পাঁচটি জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য জরিপের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে গবেষণাটি করেছেন নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের চার গবেষক।
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ, প্রসব-পূর্ব সেবা গ্রহণ (এএনসি), প্রসব-পরবর্তী সেবা গ্রহণ (পিএনসি), ১২-২৩ মাস বয়সী শিশুদের টিকা কার্যক্রম, নয় মাস থেকে ৫৯ বয়সীদের ভিটামিন প্রদান ও জ্বরের উপসর্গের সেবা গ্রহণের সংখ্যা বিশ্লেষণ করা হয় গবেষণাটিতে। এতে বলা হয়, দুই কিলোমিটারের মধ্যে যেসব কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে তাদের ২০০৪, ২০০৭, ২০১১, ২০১৪ ও ২০১৭ সালে যে সংখ্যায় মানুষ সেবা নিয়েছে, দুই কিলোমিটারের বেশি দূরত্বের কমিউনিটি ক্লিনিকের ক্ষেত্রেও বিষয়টি তেমন তারতম্য ঘটেনি।
২০১৭ সালে বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে রয়েছে—এমন কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির সেবা নিয়েছিল ৫১ শতাংশ মানুষ। একই সংখ্যক মানুষ সেবা নিয়েছে, যারা কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে দুই কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে বসবাস করত। দুই কিলোমিটার ও তার বেশি দূরত্বের এ ব্যবধানের মধ্যে একই বছরে প্রসব-পূর্ব সেবা গ্রহণের হারের ব্যবধান ছিল মাত্র ৮ শতাংশ। একইভাবে দুই কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী প্রসূতিরা বেশি দূরত্বের প্রসূতিদের চেয়ে প্রসব-পূর্ব সেবা নিয়েছেন মাত্র ১৫ শতাংশ বেশি।
দুই বছর বয়সী শিশুদের টিকা গ্রহণের হারের ব্যবধান দূরত্বের কারণে কমেনি। তেমনি ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল গ্রহণের ক্ষেত্রেও ৯-৫৯ মাস বয়সী শিশুদের হার ছিল একই। ৮১ শতাংশ শিশু ভিটামিন ‘এ’ গ্রহণ করেছে, যারা দুই কিলোমিটারের মধ্যে বা তার বেশি দূরত্বের কমিউনিটি ক্লিনিক পেয়েছে। জ্বরের উপসর্গের সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে দূরত্ব মাত্র ৪ শতাংশ মানুষের সেবা গ্রহণ কমিয়েছে। দুই কিলোমিটারের মধ্যে যে কমিউনিটি ক্লিনিক ছিল সেখানে ২৮ শতাংশ মানুষ জ্বরের জন্য সেবা নিয়েছে। আর দুই কিলোমিটারের বেশি দূরের কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে সেবা নিয়েছে ২৪ শতাংশ স্থানীয় বাসিন্দা।
গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের জন্য ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিককে মূলত তৃণমূল স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো ধরা হয়। ২০১৭-১৮ সালে গ্রামীণ এক সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের ৯৪ শতাংশ তাদের বসবাসের দুই কিলোমিটারের মধ্যে একটি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের সুবিধা পেয়েছে। ৭৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারীদের জন্য দুই কিলোমিটারের মধ্যে সরকারি সুবিধা ও ২১ শতাংশের ক্ষেত্রে দুই কিলোমিটারের মধ্যে ছিল বেসরকারি সুবিধা। স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে দূরত্ব কমাতে কমিউনিটি ক্লিনিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে সুবিধার পর্যাপ্ততার অভাব রয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় সরকারি ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত সেবা দেয়া হয়। সেবা দেয়ার জন্য ক্লিনিকগুলোয় একজন স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী (সিএইচসিপি), একজন স্বাস্থ্য সহকারী (এইচএ) ও একজন পরিবার কল্যাণ সহকারী (এফডব্লিউএ) থাকেন। এসব ক্লিনিক মাতৃত্বকালীন, গর্ভকালীন ও প্রসূতি সেবা, শিশুদের যাবতীয় রোগের সমন্বিত চিকিৎসা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা ও সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই), নবদম্পতিদের নিবন্ধন, গর্ভবতী, জন্ম-মৃত্যু, প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ (ইডিডি) নিবন্ধীকরণের কাজ করে। এছাড়া এসব ক্লিনিক থেকে পুষ্টিবিষয়ক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক শিক্ষা ও পরামর্শ, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, অটিজম ও ক্লাবফিট শনাক্তকরণ, জটিল রোগের জন্য উন্নততর স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে রেফার করা, এলাকায় একটি কার্যকর এমআইএস তথ্যের উৎস তৈরি করার মতো সেবা দেয়া হয়। পাশাপাশি ভিটামিন খাওয়ানো হয় ও দেয়া হয় ৩২ ধরনের ওষুধ। নিরাময় পদ্ধতি নির্দেশ বা কাউন্সেলিংও করা হয়।
কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি) সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে গ্রামাঞ্চলের প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের পরিকল্পনা করে সরকার। মোট সাড়ে ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরির পরিকল্পনা ছিল। শুরু থেকেই প্রকল্পটিতে জনগণের অংশগ্রহণকে প্রাধান্য দিয়ে এলাকাবাসীর দান করা জমিতেই ক্লিনিক নির্মাণ করা হচ্ছিল। ১৯৯৮-২০০১ সাল পর্যন্ত সময়ে মোট ১০ হাজার ৭২৩টি ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়। আর ২০২১ সাল পর্যন্ত নির্মাণ হয়েছে মোট ১৪ হাজার ১৪১টি কমিউনিটি ক্লিনিক। শুরুর দুই বছরে স্বল্প ব্যয়ে যে পৌনে ১১ হাজার ক্লিনিক নির্মাণ করা হয় তার আয়ুষ্কাল প্রায় শেষ। এর মধ্যে চলতি অর্থ বছর থেকে ১০ হাজার ক্লিনিকের পুনর্নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্যশিক্ষা ও সচেনতার প্রথম স্তর কমিউনিটি ক্লিনিক। মূলত গ্রামীণ পর্যায়ে প্রতিরোধমূলক ও সাধারণ চিকিৎসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। মহামারী ও দীর্ঘমেয়াদি রোগ প্রতিরোধ, শিশু স্বাস্থ্য, পুষ্টি, প্রসূতিসেবা ও পরিবার পরিকল্পনার সেবাসহ সব ধরনের সাধারণ সেবার জন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নির্ভর করতে হয় কমিউনিটি ক্লিনিকের ওপর। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের সেবার মান ও পরিধি বাড়াতে হবে। যুক্ত করতে হবে প্যারামেডিক, নার্স ও ধাত্রী।
ক্লিনিকে সেবা প্রদানের দায়িত্বে থাকা কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের (সিএইচসিপি) রোগ প্রতিরোধ ও সংক্রমণের বিষয়ে জানাশোনা কম বলে এর আগে অন্য এক গবেষণায় উঠে আসে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিজ্ঞান, চিকিৎসা প্রযুক্তি ও ওষুধবিষয়ক জার্নাল পলস গ্লোবাল পাবলিক হেলথে প্রকাশিত ওই গবেষণায় বলা হয়, দেশে সিএইচসিপির মধ্যে অর্ধেকের রোগ প্রতিরোধ ও সংক্রমণের বিষয়ে জ্ঞান নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কমিউনিটি ক্লিনিক নিয়ে সুন্দরভাবে একটি পরিকল্পনা করতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবার মান ও পরিধি বাড়াতে হবে। তৃণমূলের জন্য স্বাস্থ্য অবকাঠামোকে ঢেলে সাজাতে হবে। সরকারের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ে সঠিকভাবে উপস্থাপন ও বাস্তবায়ন করবেন সিএইচসিপিরা। গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এসব ক্লিনিকের ওপর নির্ভর করে। তবে সুবিধার অভাব ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের দক্ষতার অভাব।’
পিরোজপুর, বাগেরহাট, কুমিল্লা, খুলনা ও সাতক্ষীরার অন্তত ২০টি কমিউনিটি ক্লিনিক ঘুরে দেখা যায়, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব স্পষ্ট। কোথাও রয়েছে অবকাঠামোগত দুর্বলতা আর কোথাও সুবিধার ঘাটতি। অনেক কমিউনিটি ক্লিনিকের নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার। খুলনা ডুমুরিয়া উপজেলার রংপুর ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর কমিউনিটি ক্লিনিক এমনি একটি ক্লিনিক যেখানে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা দুর্বল ও নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা। ছাদের পলেস্তারা খসেও পড়ছে কোথাও কেথাও। ২০০০ সালে নির্মিত এ প্রতিষ্ঠানটিতে পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা কঠিন। ওই ক্লিনিকের চেয়ে অবকাঠামোগত অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও পাঁচ কিলোমিটার দূরের রংপুর কমিউনিটি ক্লিনিকে সংক্রমণ প্রতিরোধী ব্যবস্থা দেখা যায়নি। অন্তত ১০ জন সিএইচসিপির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেবার মান ও সংখ্যা না বাড়ার কারণে স্থানীয় জনগণ কমিউনিটি ক্লিনিকে আসার ব্যাপারে আগ্রহ হরিয়ে ফেলছে। আবার ওষুধের ঘাটতিও এসব ক্লিনিকের ওপর থেকে আগ্রহ উঠে যাওয়ার বড় কারণ।
কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কোথাও কোথাও কমিউনিটি ক্লিনিকের অবস্থা খুবই ভালো। আবার কোথাও কিছুটা খারাপ। এসব ক্লিনিক নিয়ে আমরা যতটুকু আশা করেছিলাম তা পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে পারিনি। একই সঙ্গে মানুষের প্রত্যাশাও বেড়েছে। তবে সময়োপযোগী পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে। আমরা চাচ্ছি কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রামীণ পর্যায়ে যেন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়ন করা যায়।’