দেশে গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্যশিক্ষা ও সচেতনতার প্রথম স্তর কমিউনিটি ক্লিনিক। মূলত গ্রামীণ পর্যায়ে প্রতিরোধমূলক ও সাধারণ চিকিৎসার জন্য এ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ। মহামারী ও দীর্ঘমেয়াদি রোগ প্রতিরোধ, শিশুস্বাস্থ্য, পুষ্টি, প্রসূতিসেবা, পরিবার পরিকল্পনার সেবাসহ সব ধরনের সাধারণ সেবার জন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নির্ভর করতে হয় কমিউনিটি ক্লিনিকের ওপর। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এসব ক্লিনিকে সেবা প্রদানের দায়িত্বে থাকা কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রোভাইডারদের (সিএইচসিপি) রোগ প্রতিরোধ ও সংক্রমণের বিষয়ে জানাশোনা কম। দেশে ১৩ হাজারের বেশি সিএইচসিপির মধ্যে অর্ধেকেরই এসব বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান নেই। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সুবিধা ও উপকরণের অভাব থাকায় সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং রোগীর সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। এতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
খুলনা ও সাতক্ষীরার অন্তত চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক ঘুরে রোগ প্রতিরোধ ও সংক্রমণের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। গত সপ্তাহে ডুমুরিয়া উপজেলার রংপুর ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, কমিউনিটি সিএইচসিপি প্রহলাদ বৈরাগী ও পরিবার কল্যাণ সহকারী দীপিকা রায় সেবাপ্রত্যাশীদের জন্য অপেক্ষা করছেন। সকাল থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত হাতে গোনা কয়েকজন এসেছিলেন সেবা নিতে। এরপর দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করে মাত্র একজন মধ্যবয়সী নারী সেবা নেন। ক্লিনিকটিতে নেই স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা। ২০০০ সালে নির্মিত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামোগত কারণে পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা বেশ কঠিন। আবার এ ক্লিনিকের চেয়ে খারাপ অবস্থা পাঁচ কিলোমিটার দূরের রংপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের। সেখানে সংক্রমণ প্রতিরোধী কোনো ব্যবস্থা দেখা যায়নি।
দেশের বিভিন্ন স্থানের পাঁচজন সিএইচসিপির সঙ্গে বণিক বার্তার কথা হয়। তারা জানান, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সেবাগ্রহীতাদের সেবা দেয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেরা সীমাবদ্ধতা অনুভব করছেন। অভাব রয়েছে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও আনুষঙ্গিক উপকরণের। কোথাও কোথাও নিরাপদ পানির সংকট রয়েছে। পয়োনিষ্কাশনও শতভাগ স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
চলতি বছরের জুনে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিজ্ঞান, চিকিৎসা প্রযুক্তি ও ওষুধবিষয়ক জার্নাল ‘পলস গ্লোবাল পাবলিক হেলথে’ প্রকাশিত এক গবেষণায় রোগ ও সংক্রমণের বিষয়ে কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবাপ্রদানকারীদের জানাশোনা ও প্রায়োগিক দক্ষতা তুলে ধরা হয়েছে। ‘হেলথকেয়ার প্রোভাইডারস ইনফেকশন প্রিভেনশন প্র্যাকটিস অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটেড ফ্যাক্টরস ইন কমিউনিটি ক্লিনিকস ইন বাংলাদেশ: আ ক্রস সেকশনাল স্টাডি’ শিরোনামের ওই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন আট গবেষক। তারা যুক্তরাষ্ট্রের শিশুস্বাস্থ্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়াটার এইড বাংলাদেশ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের দুটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত। কুড়িগ্রামের ১২৮টি কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবাপ্রদানকারীদের ওপর গবেষণা পরিচালিত হয়।
গবেষণায় বলা হয়, সংক্রমণ প্রতিরোধের বিষয়ে জ্ঞান নেই ৬৩ শতাংশ সিএইচসিপির। হাতে দৃশ্যমান কোনো ময়লা না থাকলেও অ্যালকোহলের জীবাণুনাশক দিয়ে যে হাত ধুয়ে ফেলতে হয় সে সম্পর্কে জানেন না ৪৬ শতাংশ সিএইচসিপি। কোনো যন্ত্রাংশ ব্যবহারের পর তা জীবাণুনাশক দিয়ে ধুয়ে রাখার বিষয়ে জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। প্রায় ৭২ শতাংশ সিএইচসিপি এ বিষয়ে অজ্ঞ। একইভাবে কোনো রোগীকে সেবা দেয়ার আগে হাত ধোয়ায় অভ্যস্ত নন ৪২ শতাংশ সেবা প্রদানকারী। ৯২ শতাংশ সেবা প্রদানকারী সংক্রমণ প্রতিরোধের নির্দেশিকা মানছেন না। টিকা প্রদান বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় ইনজেকশন শরীরে প্রবেশ করানোর পর এসব বর্জ্য সঠিক নিয়মে নির্দিষ্ট বক্সে রাখা হচ্ছে না। ৪৫ শতাংশ সেবা প্রদানকারী ইনজেকশনের সুঁচ ব্যবহারের পর তাতে ক্লিব বা মুখ লাগিয়ে বক্সে রাখেন না।
গবেষকদের অন্যতম ও ওয়াটার এইড বাংলাদেশের স্বাস্থ্য পরামর্শক ডা. নূরুল্লাহ আওয়াল বলেন, রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে সেবা প্রদানকারীদের ধারণা ও প্রায়োগিক কার্যক্রম পর্যালোচনার জন্য এ গবেষণা করা হয়। তিনি বলেন, রোগ প্রতিরোধ ও সংক্রমণের বিষয়ে যে নির্দেশিকা রয়েছে সে সম্পর্কে সিএইচসিপিদের জানাশোনা কতটুকু ও বাস্তবে তারা কতটুকু প্রয়োগ করেন তা দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। এর পরও সব ক্লিনিকের অবস্থা এমন তা বলতে পারি না। কোনো কোনো ক্লিনিকে গিয়ে অবস্থা অনেক ভালো পাওয়া যাবে আবার কোথাও হয়তো অবস্থা খুবই শোচনীয়। গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল এসব বিষয় তুলে ধরা। যেন সংশ্লিষ্ট বিভাগ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে।
ডুমুরিয়া ইউনিয়নের সিএইচসিপি প্রহলাদ বৈরাগী ও স্বপ্না ঢালী বণিক বার্তাকে বলেন, সংক্রমণ, রোগ প্রতিরোধ ও রোগীদের সেবার বিষয়ে যে প্রশিক্ষণ হয় তার পরিসর আরো বাড়ানো উচিত। প্রতিনিয়ত বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিলে আমরা আরো সহজে তা বাস্তবায়ন করতে পারতাম।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কমিউনিটি বেজড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি) সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে গ্রামাঞ্চলের প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের পরিকল্পনা করে সরকার। শুরু থেকেই প্রকল্পটিতে জনগণের অংশগ্রহণকে প্রাধান্য দিয়ে এলাকাবাসীর দান করা জমিতেই ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৯৯৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৪ হাজার ১৪১টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়েছে।
ছুটির দিন বাদে সপ্তাহের অন্যান্য দিন সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা দেয়া হয়। প্রতিটিতে একজন কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী (সিএইচসিপি), একজন স্বাস্থ্য সহকারী (এইচএ) ও একজন পরিবার কল্যাণ সহকারী (এফডব্লিউএ) থাকেন। এসব ক্লিনিক মাতৃত্বকালীন, গর্ভকালীন ও প্রসূতিসেবা, শিশুদের যাবতীয় রোগের সমন্বিত চিকিৎসা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা ও সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই), নব দম্পতিদের রেজিস্ট্রার, গর্ভবতী মা, জন্ম-মৃত্যু, প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ (ইডিডি) নিবন্ধীকরণের কাজ করে। পুষ্টিবিষয়ক শিক্ষা ও পুষ্টিকর অতিরিক্ত খাদ্য সরবরাহ, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক শিক্ষা ও পরামর্শ, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, অটিজম ও ক্লাব ফুট বা চক্রপদ শনাক্তকরণ (শিশুদের পায়ের পাতার জন্মগত বিকৃতি), জটিল রোগের জন্য উন্নততর স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে রেফার করা, এলাকায় একটি কার্যকরী এমআইএস তথ্যের উৎস তৈরি করার সেবা প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশের সিএইচসিপিদের মধ্যে রোগ, সংক্রমণ ও প্রতিরোধী জ্ঞান না থাকা সঠিক অনুশীলনকে প্রভাবিত করছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে অবস্থান ইথিওপিয়া, কাঠমান্ডু ও নেপালের নিচে। দেশে সিএইচসিপিদের মধ্যে স্নাতকোত্তর, স্নাতক ডিগ্রিধারী থাকলেও মাধ্যমিকে উন্নীতরাও রয়েছেন। বিজ্ঞান বিভাগের পাশাপাশি কলা ও বাণিজ্যে শিক্ষার্থীরা সিএইচসিপি হয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এদের নার্সিং, মেডিসিন, মিডওয়াইফারি, কমিউনিটি মেডিসিন, মাইক্রোবায়োলজি, জনস্বাস্থ্যে ডিপ্লোমা প্রশিক্ষণ দিয়ে উপযুক্ত করে তোলা সম্ভব।
সিএইচসিপিদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার কথা ছিল না উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, শুরুতে কথা ছিল—সিএইচসিপিরা ইন্টারনেট চালনায় দক্ষ হবেন। তারা কমিউনিটির স্বাস্থ্যগত তথ্যকে সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করবেন ও কেন্দ্রে পাঠাবেন। একই সঙ্গে সরকারের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত নির্দেশনা মাঠপর্যায়ে সঠিকভাবে উপস্থাপন করবেন। আর তাদের তদারকিতে স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারী প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবেন। তবে এখন চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ অবস্থায় সিএইচসিপি ও ক্লিনিকে অন্যদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। একই সঙ্গে তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য উপকরণ দিতে হবে। সেবা ঠিক রাখতে ও মান বাড়াতে কমিউনিটি ক্লিনিকে নার্স, মিডওয়াইফ নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। ন্যূনতম কমিউনিটি নার্স নিয়োগ দিতে হবে।
সিবিএইচসি বলছে, কমিউনিটি ক্লিনিক গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো। এখানে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যশিক্ষা, কৈশোর স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধ নিশ্চিত করা হয়। টিকাদান কর্মসূচি ও পুষ্টির কার্যক্রম চালানো হয়। প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এসব ক্লিনিক থেকে সেবাগ্রহীতাদের পরবর্তী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে রেফার করা হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকে ৩২ ধরনের ওষুধ দেয়া হয়। ভিটামিন খাওয়ানো হয়। নিরাময় পদ্ধতি নির্দেশ বা কাউন্সেলিং করা হয়।
কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বণিক বার্তাকে বলেন, উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা সিএইচসিপির জানা-শোনায় অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা তাদের প্রস্তুত করতে আরো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি। তবে কমিউনিটি ক্লিনিকের মডেল সারা বিশ্বে সমাদৃত। মানুষ এ ক্লিনিক বিষয়ে সন্তুষ্ট। এর পরও আমাদের সমস্যা স্বীকার করছি। সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা কাজ করছি।