গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার কমে ৬০ শতাংশে নিচে নেমেছিল। ধীরগতিতে হলেও কমছিল কিশোরী মায়ের সংখ্যা। কিন্তু চলমান করোনা পরিস্থিতিতে অনেকটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে এ অগ্রগতি। মহামারীর এ সময়ে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও বেড়েছে বাল্যবিবাহ। এতে বাড়ছে কিশোরীদের গর্ভধারণ, যা বাড়িয়ে দিচ্ছে মাতৃমৃত্যু ও অপুষ্ট শিশু জন্মদানের ঝুঁকি।
সেভ দ্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, করোনা মহামারীর এ সময়ে দেশে গরিব ও গ্রামীণ পরিবারগুলোয় কিশোরীদের গর্ভধারণ বেড়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সরবরাহ ও গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে বাংলাদেশে দরিদ্র পরিবারে বিবাহিত কিশোরী গর্ভধারণের হার ৪১ শতাংশ।
করোনার এ সময়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ কম হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরসংশ্লিষ্টরাও। তারা বলেছেন, স্বাভাবিক সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক দম্পতির চেয়ে কিশোর দম্পতির মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের হার কম। কিন্তু করোনার এ সময়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণের বিতরণ কম হওয়ায় জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণও কমেছে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (এমআইএস) আবু তাহের মো. সানাউল্লাহ নূরী বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণ সরবরাহ বজায় রাখা হয়েছে। আমরা মাঠকর্মী পর্যন্ত উপকরণগুলো পৌঁছে দিয়েছি। আমাদের চেষ্টা থাকলেও করোনা মহামারীর কারণে অনেকেই তা পাননি। এতে কিশোরীদের গর্ভধারণ বেড়ে যেতে পারে।
চলতি মাসেই ‘গ্লোবাল গার্লহুড ২০২০: হাউ কভিড-১৯ ইজ পুটিং প্রগ্রেস ইন পেরিল’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে সেভ দ্য চিলড্রেন। এতে বলা হয়, আগামী পাঁচ বছর বিশ্বজুড়ে আরো ২৫ লাখ কিশোরী বাল্যবিবাহের ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। চলতি বছরেই পাঁচ লাখের মতো মেয়েকে বাল্যবিবাহের মধ্যে ঠেলে দেয়া হবে। এতে ২০২০ সালেই বাল্যবিবাহের সংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি ২৫ লাখের ওপরে। দুই মাসের মধ্যেই ১০ লাখ ৪১ হাজার কিশোরী গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনার মধ্যে রয়েছে। এ প্রসূতিরা প্রসবের সময় মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়বে। ৭৫টি দেশের (বিশ্ব জনসংখ্যার ৬৭ শতাংশ ) বর্তমান প্রেক্ষাপটে গবেষণাটি করেছে সংস্থাটি।
বিশ্বের প্রায় পাঁচ কোটি বিবাহিত নারী ও কিশোরী করোনাভাইরাসের কারণে সঠিকভাবে গর্ভনিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেননি বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে সেভ দ্য চিলড্রেন। এতে বলা হয়েছে, ৩০ লাখের বেশি অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের ঘটনা ঘটেছে। এতে ২৭ লাখ অনিরাপদ গর্ভপাত হবে, যাতে ১১ হাজার কিশোরীর মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশের গাইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৮ বছরের আগে বিয়ে হলে কিশোরীরা অপুষ্টিতে ভোগে। পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে দরিদ্র ও অশিক্ষিত মেয়েদের গর্ভধারণের হার বেশি। এতে পুষ্টির অভাবে থাকে গর্ভের সন্তান। ২০ বছর বয়সের আগে সন্তান জন্ম দেয়া মায়েদের মৃত্যু ঝুঁকি বেশি।
কিশোরী শারীরিক ও মানসিকভাবে বিয়ে ও সন্তান জন্মদানের জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত থাকে না উল্লেখ করে বারডেম জেনারেল হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতিরোগ বিদ্যা বিভাগের চিকিৎসক ডা. মাহমুদা আক্তার বলেন, ২০ বছর বয়সের আগে কিশোরীর পেলভিস ছোট থাকে। রক্তস্বল্পতা, প্রসবপূর্ব খিঁচুনি, বাধাগ্রস্ত প্রসব, প্রসবের সময় আঘাতে প্রজনন অঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হয়। এতে রক্তপাত বেশি হয় এবং জন্ম দেয়া সন্তানের ওজন কম থাকে।
কিশোরী প্রসূতির ক্ষেত্রে প্রসবটা অনেক ক্ষেত্রে সময়ের আগে হয় উল্লেখ করে ডা. মাহমুদা বলেন, এ সময় কিশোরী প্রসূতির অন্যান্য প্রসূতির চেয়ে ব্যথা বেশি হয়। তাদের প্রায় সবাই সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিয়ে থাকেন। অল্প বয়সে সন্তান জন্ম দেয়ায় জীবনভর বেশকিছু স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকতে হয় এবং সিজারের কারণে আরো কিছু সমস্যাও যুক্ত হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।